Sylhet Today 24 PRINT

তবুও আমাদের এত চিকিৎসক বিদ্বেষ

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ |  ০২ অক্টোবর, ২০২০

মাসখানেক আগে গভীর রাতে নিজগৃহে বর্বরতম হামলার শিকার ইউএনও ওয়াহিদা খানমের কথা আপনারা নিশ্চয় ভুলে যাননি! না! তার বাসার আলমিরাতে অবিশ্বাস্যরকমভাবে কেন চল্লিশ লাখ টাকা আর পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পাওয়া গিয়েছিলো কিংবা বৈধ উপায়ে অর্জিত হলেও কেউ এতো টাকা একসাথে বাসায় রাখে কি না সেই কাসুন্দি ঘাটতে আজ আমি আসিনি। এসেছি আমার পেশার সহযোদ্ধাদের, আমার দেশের চিকিৎসকদের সফলতার দু-একটা গল্প শোনাতে!

বর্বরতম হামলার শিকার হয়ে মস্তিষ্কে ভয়াবহ রকমের ক্ষত নিয়ে যে ওয়াহিদা খানম প্রায় মরতে বসেছিলো সেই ওয়াহিদা খানম আজ মাত্র একমাসের ব্যবধানে দিব্যি সুস্থ হয়ে নিজেই পায়ে হেঁটে হাসপাতাল ছেড়েছেন। সময়টা করোনাকাল না হলে হয়তো সরকারি ও প্রশাসনিক সহায়তায় ইউরোপ-এমেরিকা বা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডের মতো উন্নত কোন দেশে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো। অনিবার্য কারণে সেটা সম্ভব না হওয়ায় বলা যায় একরকম বাধ্য হয়েই আমার দেশের চিকিৎসকদের উপরই আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ভরসা রেখেছিলেন। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও তার চিকিৎসার ভার নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন যদিও আজ পর্যন্ত রোগীর স্বজনের হাতে নির্যাতিত অসহায় মুমুর্ষু কোন চিকিৎসকের চিকিৎসার ভার নিতে দেখলাম না!

যাইহোক, উপরওয়ালাদের দয়ায় আমার দেশের চিকিৎসকরা ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ব্রেইন সার্জারির মতো একটা জটিল অপারেশন করার সুযোগ পেয়েছিলো, সুযোগ পেয়েছিলো তাদের যোগ্যতাকে আরও একবার প্রমাণ করার।

আমরা সবসময়ই বলি- আমরা রোগের চিকিৎসা করি, মৃত্যুর নয়। সারা পৃথিবীর তাবৎ চিকিৎসকরাই রোগের চিকিৎসা করে, মৃত্যুর চিকিৎসা কেউ করে না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত প্রকৃতির অমোঘ-অলঙ্ঘনীয় নিয়মে যখনই এদেশের কোন হাসপাতালে কোন রোগীর মৃত্যু হয় তখনই তার পুরো দায় এসে পড়ে আমাদের চিকিৎসকদের ঘাড়ে। যেন পৃথিবীর আর কোন দেশে, আর কোন হাসপাতালে কখনো কোন রোগীর মৃত্যু হয় না!

আমরা সবাই এমেরিকাকে সারা পৃথিবীর জন্য আইকন হিসেবে মানি, সেই এমেরিকার একটি নামকরা হাসপাতালে সর্বজনপ্রিয় সুনামধন্য ও স্বনামখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদ মারা গিয়েছিলেন। যে অপারেশনের কম্প্লিকেশনে হুমায়ূন আহমেদ সেদিন মারা গিয়েছিলেন সেই একইরকম অপারেশন এমনকি তার চেয়েও জটিল অপারেশন আমার দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেলে ও বিএসএমএমইউতে প্রতিনিয়ত হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সেই খবর কেউ কখনো রাখে না!

হুমায়ূন আহমেদ আমার মতো আমাদের অনেক চিকিৎসকেরও খুব প্রিয় একজন লেখক ছিলেন। তারপরও বলি, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা সেদিন কপালগুনে বেঁচে গিয়েছিলেন এই কারণে যে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সেদিন এইদেশের কোন চিকিৎসকের চিকিৎসাধীনে এই দেশের কোন হাসপাতালে হয়নি। যদি সেটা হতো তাহলে 'চিকিৎসাবিদ্যা'র 'অ আ ক খ' না জানা সাংবাদিকরাও সেদিন চিকিৎসকের চিকিৎসার ভুল ধরতে হামলে পড়তো, আর হুমায়ূন আহমেদের পাঠকেরা হাসপাতাল ভাঙতে আর চিকিৎসকের জান কবজ করতে তীব্র বেগে ছুটে আসতো!

প্রায় বছর দুই আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রায় যমপুরী থেকে ফিরিয়ে এনেছিলো আমার দেশের চিকিৎসকরাই। বাঙালি প্রথমে আমার দেশের চিকিৎসকদের এই সফলতাকে আঁচই করতে পারেনি। জগদ্বিদিত কার্ডিয়াক সার্জন দেবি শেঠি এসে যখন আমার দেশের চিকিৎসকদের এই সফলতা ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে সার্টিফিকেট দিলেন তখনই হয়তো বাঙালি একটু নড়েচড়ে বসেছিলো; যদিও তার রেশও বেশিদিন টেকেনি! সেই রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনাতে এক বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুতে 'ভুল চিকিৎসা'র মিথ্যা অভিযোগ এনে রোগীর স্বজনেরা রোগীর চিকিৎসক শ্রদ্ধেয় ডা. রাকিবকে পিটিয়েই মেরে ফেলেছিলো!

আমার দেশের মানুষেরা ভুলে যায়, বৃক্ষমানব আবুল বাজনদার কিংবা রক্তনালীর জটিল রোগে আক্রান্ত মুক্তামণীর সফল অপারেশন আমার দেশের চিকিৎসকরাই করেছিলো। লাবিবা লামিসার মতো অনেক জোড়া-বাচ্চার জটিল অপারেশন সফলভাবেই আমার দেশের চিকিৎসকরাই করেছেন। আমার দেশের চিকিৎসকদের এরকম অসংখ্য অসংখ্য সফলতার গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদেশেরই আনাচে কানাচে!

তারপরেও অবাক হই, হতাশ হই, ভাষা হারিয়ে ফেলি যখন দেখি আমার দেশেরই শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা পদে পদে চরমমাত্রায় শুধু চিকিৎসক বিদ্বেষ আর চিকিৎসক বিদ্বেষ!

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.