Sylhet Today 24 PRINT

মিজানুর রহমান খান: মেধাবীরা কেন এভাবে দ্রুত চলে যায়

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১২ জানুয়ারী, ২০২১

মিজানুর রহমান খান

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান সোমবার (১১ জানুয়ারি) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

তিন দশকেরও বেশি সময়ের সাংবাদিকতায় আইন-আদালত বিষয়ক লেখালেখির জন্য সব মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন মিজানুর রহমান খান। তার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই তাদের শোকাহত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন।

সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান লিখেন, করোনায় বড় অকালেই চলে গেলেন আমার এক সময়ের সহকর্মী মিজানুর রহমান খান। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক। সংবিধান আইন আদালতের এমন বিশ্লেষণ পাণ্ডিত্য আর মিলবে না কলামে। শূন্যস্থান পূরণ হবার নয় মিজানুর রহমান খানের। গভীর শোক ও বেদনায় বিদায় বন্ধু। মেধাবীরা চলে যায় কেন অকালে! আল্লাহ রহম করো।

সাংবাদিক ও লেখক জাহিদ নেওয়াজ খান লিখেন, আরও কতকিছু পাবার কথা ছিল আপনার কাছ থেকে! এত দ্রুত চলে গেলেন! আপনার আর কোন বিশ্লেষণ পড়া হবে না। সহকর্মীদের সমৃদ্ধ করার আর কোন সেশনে আপনাকে ডাকা যাবে না। কোন প্রতিবেদনের জন্য আর কখনও কোন রিপোর্টারকে আপনার সাক্ষাতকারের জন্য পাঠানো সম্ভব হবে না। আর কোন লাইভে আপনাকে ইনভাইট করতে পারবো না। ভালো থাকবেন, মিজান ভাই।

কবি মোজতবা আহমেদ মোরশেদ লিখেন, শোকের খবর চারদিকে। আইন ও রাজনীতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখা সাংবাদিকতায় নিবেদিত প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান করোনায় হার মেনে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে বিদায় নিলেন। গত কদিন ধরেই দম বন্ধ করে তার খবর রাখছিলাম। সাংবাদিক বন্ধুরা তার রোগ বিষয়ে আপডেট দিচ্ছিলো। কিন্তু সব শেষ!

এমনিতেই ভার হয়ে হয়ে আছে মন সকাল হতে। সকালেই দুম করে জেনেছি বন্ধু চিত্রকর কাজী সালাহউদ্দিন এর ছোটভাই সালেহউদ্দিন শুক্রবার পঞ্চাশ পেরুনো বয়সে ইন্তেকাল করেছে। আর এখন ভর সন্ধ্যায় চলে গেলেন মিজানুর রহমান খান। অনেক বছর আগে আমার বাসার কাছেই ধানমন্ডি কেএফসির সামনে সাংবাদিক ও লেখক মহসিন হাবিবের মাধ্যমে তার সাথে আলাপ। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। আমাকে মুগ্ধ করতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তার গভীর অনুরাগ। এসব নিয়েই বছর তিনেক আগে তার ধানমন্ডির বাসায় সাতসকালে চা হাতে একসাথে এক দীর্ঘ সময় পার করেছি। বাসায় পৌঁছে বেশ অবাক হয়েছি। বাবা, মা, ভাই বোন- অনেকজন মিলিয়ে একটা একান্নবর্তী পরিবার। এ লুটেরা সমাজে অদ্ভুত এক সাদামাটা জীবনযাপন সবাই মিলে! কমনস্পেসে এক মস্ত বিছানা। তাতে একসাথে পাশাপাশি চারজন। তখনো ওরা ঘুম ফেলে জাগেনি। সঙ্কোচে পড়লাম। শুধু শুধু তার আমন্ত্রণে এততো সকালে চলে এলাম।

তিনি কিন্তু আপ্লুত। ত্রস্ত হলেন। লুঙ্গি পরেই আমার বসার জায়গা বাছতে হুলুস্থুল। অবশেষ দুজনেই বিছানার ওপরেই বসে পড়লাম। সে অনেক গল্প। তার কী অসীম মনোযোগ মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে। আমার কাছ হতে হলুদ হয়ে ওঠা দলিলগুলোর ছবি টাসটাস করে তুলে চলেছেন। আর যথেষ্ট করে আমার প্রতি অনুযোগ করছেন। এসব হীরের মতো দলিল দিয়ে ক্যানো আমি বই প্রকাশ করিনি! তার বিস্ময়!

হারিয়ে গেলো অনেক কিছুতে তৃষ্ণার্ত আর চোখে বিস্ময় নিয়ে বামনদের বিপরীতে একজন বড় মাপের সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। চারদিকে মৃত্যুর ক্রম পথে নিজেকে আমার মনে হচ্ছে বনপোড়া হরিণ! পোড়া হৃদয় নিয়েই বলি, বেঁচে থাকুন আপনার লেখায়। কর্মে।

প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক ফজলুল বারী স্মৃতি রোমন্থন করে ফেসবুকে লিখেন, তাঁর ভাই সিদ্দিককে প্রায় নক করে বলতাম, ভাই একটা পোষ্ট দেই? আর কাকে বলবো- আমরা একসঙ্গে বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করেছি। বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের আদর করে ডাকতেন ‘লক্ষ্মী ভাই’। মিজানকে ফোনে আমি লক্ষ্মী ভাই ডাকলে তিনি মজা পেয়ে হো-হো করে হাসতেন। তাঁর ছেলেটাকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়ানোর খুব ইচ্ছা ছিল, এরজন্য মাঝে মাঝে ফোন করতেন; সেই ছেলেটা জাতিসংঘ মহাসচিবের বৃত্তি পাওয়াতে আর অস্ট্রেলিয়া আসেনি।

সাংবাদিক রফিকুল রঞ্জু ফেসবুকে লিখেন, প্রথম চাকরির জন্য যে তিনজনের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম মিজান ভাই (মিজানুর রহমান খান) তাদের একজন। সেই সাক্ষাৎকারের পর একসাথে আমরা সমকালে কাজ করেছি। পরে প্রথম আলোতেও। সংবিধান-আইন বিষয়ে পড়াশুনায় উৎসাহ পেয়েছি তাকে দেখেই। একজন আগে চলে গেছেন- গোলাম সারওয়ার। আজ না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রিয় মিজান ভাই। শ্রদ্ধা...

লোকগবেষক ও সাংবাদিক সুমনকুমার দাশ ফেসবুকে লিখেন, মিজান ভাই, প্রিয় মিজানুর রহমান খান। আপনার কণ্ঠ আর শোনা হবে না, ভাবতেই পারছি না!

কবি আলমগীর শাহরিয়ার ফেসবুকে লিখেন, দেশ একজন গুণী সাংবাদিককে হারাল। মিজানুর রহমান খান আইনের ছাত্র না হয়েও দেশ বিদেশের এত ভালো আইন আদালত সংবিধানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বুঝতেন, জানতেন অনেকটা অভাবনীয়। তাঁর মতো ল লিটারেচার এদেশে খোদ আইনেরই খুব কম লোকজন পড়েছেন। মিজানুর রহমান খান কলাম লিখলে সংশ্লিষ্ট মহলে, আইন অঙ্গনে সাড়া পড়ে যেত। আমার কথা নয়, ২০১২ সালে মানবজমিনে কাজ করার সময় সম্পাদক মতি ভাইয়ের কাছে (মতিউর রহমান চৌধুরী) কাছে শোনা। ২০১৯ -এর সেপ্টেম্বরের এক শনিবারে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আলোর ইশকুলে এসেছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের উপর আলোচনা করতে। কী শিশুসারল্য নিয়ে কত কঠিন সব কথা বলে গেলেন মানুষটা। প্রাণখোলা এক চিলতে হাসি সবসময় লেগে থাকত মুখে। এই ছিল শেষ দেখা। তিনি আজ আর নেই। এই শূন্যতা অপূরণীয়। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা।

মিজানুর রহমান খানের জন্ম ১৯৬৭ সালের ৩১ অক্টোবর, ঝালকাঠির নলছিটিতে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। বরিশালে স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন মিজানুর রহমান খান। নব্বই দশকের শুরুর দিকে দৈনিক খবর পত্রিকায় কাজের মধ্য দিয়ে ঢাকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। সর্বশেষ প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.