Sylhet Today 24 PRINT

ফিরে আসা মানুষেরা কাদের ভয় করেন?

আলী রীয়াজ |  ০৬ মার্চ, ২০২১

গত বছর মে মাস থেকে আটক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর জামিনে মুক্ত হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিশোরকে গত বছরের মে মাসের ২ তারিখ তাঁর বাড়ি থেকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। তাঁদের সংখ্যা ছিলো ১৬-১৭ জন। তাঁরা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞাতস্থানে নির্যাতন চালিয়েছে, এতটাই আঘাত করা হয়েছে যে তাতে তাঁর কান থেকে পুঁজ বেরুচ্ছে, তিনি হাঁটতে পারছেন না; তাঁকে যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে এই ব্যক্তিদের কাছে কিশোর সম্পর্কে অনেক তথ্য ছিলো। এই ব্যক্তিরা তুলে নেয়ার ৬৯ ঘণ্টা পরে তাঁকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তারপরে দশ মাস কিশোর সরকারের ‘হেফাজতে’ ছিলেন – কারাগারে। এই সব ঘটনা প্রবাহ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যেগুলো তোলা জরুরি এবং সেগুলোর উত্তর খোঁজা দরকার।

প্রথম বিষয় হচ্ছে এই ৬৯ ঘণ্টা কিশোর কাদের হাতে ছিলো এবং কীভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত র‍্যাবের কার্যালয়ে উপস্থিত হলেন? কিশোর–ই প্রথম ব্যক্তি নন যাকে সাদা পোশাকধারীরা নিয়ে যাবার পরে পুলিশ বা র‍্যাবের কাছে পাওয়া গেছে।

২০২০ সালের শেষের দিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) হিসেবে দিয়েছিলো যে ১৩ বছরে ৬০৪ জন মানুষ গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন৷ এই ৮৯ জনের মতোই দুর্ভাগ্য কিশোরের। কিশোর জামিন পাবার পরে আমরা এখন বিস্তারিত জানতে পারছি। আমরা অনুমান করি পুলিশ এবং আদালত জানেন যে ৬৯ ঘণ্টার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা তাঁরা জানেন দশ মাস আগেই।

সরকার দাবি করছে যে, তাঁকে আটক করা হয়েছে ৫ মে। এই ৬৯ ঘণ্টার বিষয়ে জানেন না, তাহলে গত ১০ মাস সরকার কেনো এই বিষয়ে তদন্ত করলো না? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে কিশোর আঘাত পেয়েছেন দশ মাসে আগে, তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন– এই দশ মাস তিনি কারাগারে ছিলেন, তাঁকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়েছে কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। আর যদি সরকার বলতে চান যে, দশ মাস আগে কিশোরকে কেউ তুলে নিয়ে যায়নি, র‍্যাব-ই আটক করেছে তাহলে কী এই দাঁড়ায় না যে কিশোর তাঁদের হেফাজতে থাকার সময়, কিংবা কারাগারে নির্যাতিত হয়েছেন? সেই তদন্ত কে করবে? কে এর দায়িত্ব নেবে?

বাংলাদেশে গুমের অবস্থা থেকে যারা ফেরেন তাঁরা কথা বলেন না; যারা ফিরে এসেছেন তাঁরা যে ভয়েই কথা বলেন না তা আমরা অনুমান করতে পারি। কোনোদিন রাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে এই বিষয়ে জানতে চেয়েছে এমন মনে পড়ে না। ফিরে আসা মানুষেরা কাদের ভয় করেন? মুক্ত অবস্থায়ও তাঁদের এই ভয় প্রমাণ করে এমন শক্তি আছে যাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রও অপারগ! পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন উঠতে পারে– যারা ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ হবার পরে ‘আটক’ হন তাঁর ঠিক কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ হন? কিশোর জামিন লাভ করে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিষয়ে আলোচনাটি অন্য সময়ের জন্যে তুলে রাখলাম।

প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয় বলি। ২০১১ সালে কমিশনের তৎকালীন প্রধান ড. মিজানুর রহমান এই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কমিশন এক বা একাধিক গুমের ঘটনাকে বেছে নিয়ে তদন্ত করবে। কিন্তু কী হয়েছে এখন এক দশক পরে তা আমরা জানি। ফলে এই আশা করার কারণ নেই যে কিশোরের এই সব অভিযোগকে বিবেচনায় নিয়ে কমিশন এই প্রশ্নগুলো তুলবে। এখন এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এমন আশা করিনা, কিন্তু অন্তত রেকর্ড হিসেবে এই প্রশ্নগুলো এখানে থাকলো।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।
লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.