Sylhet Today 24 PRINT

বন্ধু, বিদায়...

রেজা ঘটক |  ২১ জুলাই, ২০২১

সায়মন ড্রিং ছিলেন বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার হিসেবে সায়মন ড্রিং কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করতেন। অনেক বছর ধরে তিনি লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলের উপর সাংবাদিকতা করছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবার কারণে দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো- সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও। মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী 'Operation Search Light' নামে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি গণহত্যার সেই খবর সংগ্রহ করেন। পাকসেনারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ ও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরদিন সকালেই তাদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেয় উড়োজাহাজে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সায়মন ড্রিংকে তখন খুঁজে পায়নি।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তারপর ঢাকার এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খবর প্রচার করার জন্য আবারো তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে পালিয়ে ব্যাংকক চলে যান। এরপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন।

যা লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে পাকিস্তানী বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। এরপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর তিনি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

সায়মন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবার এসেছিলেন ২০০০ সালে। এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে সরকার সায়মন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাঁকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দিলে তিনি বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হন!

মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত (২০১২ সালে) এ দেশের অকৃত্রিম বন্ধু সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে অবদান রেখেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সায়মন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব।

সায়মন ড্রিংয়ের স্ত্রী ফিয়োনার কর্মস্থল রোমানিয়া। সেখানে নিয়মিত যেতেন তিনি। গত শুক্রবার সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ হারায় এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। রেড স্যালুট কমরেড।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.