Sylhet Today 24 PRINT

কোভিড আইসিইউ: এক অন্তঃসত্ত্বার ফিরে আসার অপার্থিব গল্প

ডা. আলিম আল রাজি |  ৩১ আগস্ট, ২০২১

রিনি দাস (ছদ্মনাম) যখন আইসিইউতে আসলেন তখনও জানতাম না ২৮ বছরের এই মেয়েটাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এই গল্পটা লিখবো বা লিখতে পারবো। গল্পটা শুধু ২৮ বছর বয়সী রিনি দাসের নয় এই গল্পটা তাঁর জরায়ুতে থাকা ২২ সপ্তাহের শিশুটিরও… এবং এই গল্পটা আমাদেরও।

প্রেগনেন্সি এবং কোভিড– এই শতকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুগল! পুরো পৃথিবীর মতো আমাদের আইসিইউও সাক্ষী হয়ে আছে এমন অনেক ঘটনার। জরায়ুতে ঋণাত্মক বয়সের শিশু এবং বুকের ভিতর এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী থেকেই চলে যেতে হয়েছে রোকেয়া বেগম কিংবা মরিয়ম আক্তারকে! ... রিনি দাসও চলে যাচ্ছেন! আমাদের চোখের সামনেই!

১০.৮.২০২১, রাত ১২টা ১০ মিনিট। সাব্বির এবং আমি সেই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লাম। রিনি দাস মারা যাচ্ছেন! হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যন্ত্রটা বিপ-বিপ শব্দ করছে, তার পক্ষে এরচেয়ে বেশি অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব না। এদিকে মনিটর দেখাচ্ছে, রিনি দাসের রক্তে অক্সিজেন প্রায় নেই! ৫৬%! ইসিজি বলছে – একটু পরেই হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!

আমার ক্ষুদ্র ডাক্তারি জীবন। তার এক পঞ্চমাংশ অধ্যায় কেটে গেছে কোভিড আইসিইউ নামক নন্দিত নরকে। সাব্বির এবং আমি দুজনেই বুঝতে পারছি, এটাই শেষ মুহূর্ত। আর কয়েক মিনিট পরেই রিনি দাসের হৃৎপিণ্ড আঁকাবাঁকা নৃত্য থামিয়ে দিয়ে সরলরেখা তৈরি করবে। ...দ্যা ফ্ল্যাট লাইন!

রিনি দাসের চোখ বুজে আসছে। ২৮ বছরের মেয়েটি কোটি বছরের অভিমান এবং যন্ত্রণা নিয়ে ভারি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকালো একবার। আমরা তাঁর জন্য, তাঁর সন্তানের কিছুই করতে পারছিনা! কিছুই না! আসলে আমাদের হাতে আর কিছুই নেই। শেষ যে ভেন্টিলেটর মেশিনটা ছিল সেটা বিকেলে চলে গেছে অন্য আরেকজনের ভাগ্যে!

রিনি দাস মারা যাচ্ছেন, তাঁর ২২ সপ্তাহ বয়সী সন্তান এই গ্রহে নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই তার মা শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে নিচ্ছেন!

সাব্বির আমার দিকে তাকায়, আমি সাব্বিরের দিকে তাকাই। হঠাৎ মনে হলো, ভ্যান্টিলেটর মেশিন নেই তো কী হয়েছে হাত তো আছে! ফুসফুসে টিউব দিয়ে, সেই টিউবে বেলুন চেপে অক্সিজেন দেবো। এটা একটু বেশি জুয়া হয়ে যায়। কোভিড প্যাশেন্টকে ইন্টুবেট করা মানে তাঁর আর মৃত্যুর দূরত্ব আরও কমিয়ে দেয়া। তাছাড়া হাত দিয়ে চাপবোই বা কতক্ষণ! তাও… হাত দিয়ে চেপে রাতটা যদি কাটিয়ে দেয়া যায় তাহলে সকালে হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরা ইন্টুবেট করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিলাম।

ঠিক তখন ঘটলো একটা ঘটনা, যে ঘটনার চিত্রনাট্য পৃথিবীতে লেখা সম্ভব না। কোনো লেখকের ক্ষমতা নেই মর্ত্যের কালি দিয়ে এই চিত্রনাট্য লিখবে! অন্য এক বেডের অন্য এক বৃদ্ধা রোগী রাতের খাবার খাননি। রোগীর মেয়ে রোগীর সিপ্যাপ মাস্ক অল্প একটু খুলে তাঁকে খাবার দিচ্ছিলেন। আমি একটু চোখ কচলে তাকালাম! দেখি এই মাস্ক খোলা অবস্থাতেও রোগীর অক্সিজেন লেভেল খুব একটা কমছে না। সাব্বিরকে ডাক দিয়ে দেখালাম। আমার দিকে তাকিয়ে সাব্বির সাথে সাথে বুঝে গেলো কী করতে চাচ্ছি। সাব্বির আমাকে বললো– 'ভাই বিষয়টা কি ঠিক হবে? এই রোগীও ক্রিটিকাল। মেশিন রিনি দাসকে দিয়ে দেওয়ার পর এই বৃদ্ধা যদি খারাপ হন, তাহলে আমাদেরকে তাঁরা সোজা মেরে ফেলবে! আর একবার দিয়ে দেয়ার পর যদি রিনি দাস থেকে আবার মেশিন খুলতে যান তাহলে রিনি দাসের আত্মীয়রা আমাদেরকে মেরে ফেলবে।' আমি বললাম, ‘মার তো খাবোই, কাল সকালে পত্রিকায় ছবিসহ খবর আসবে– মেশিন কেড়ে নিয়ে রোগী মেরে ফেললেন দুই ডাক্তার!’ কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তো উপায়ও নেই!

বৃদ্ধার স্বজনদের ডেকে বুঝালাম– ২৮ বছরের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা মারা যাচ্ছে। আপনাদের মেশিনটা তাঁর লাগবে। পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধাবস্থায় এভাবেই বাঁচতে হয়, বাঁচাতে হয়। খুব অনিচ্ছা নিয়ে হলেও তারা রাজি হলেন। রিনি দাসের স্বজনদের ডেকে বুঝালাম– মেশিনের বন্দোবস্ত হয়েছে। তবে যদি বৃদ্ধার আবার দরকার হয় তাহলে মেশিনটা হয়তো নিয়ে যেতে হবে। তাই এখন আপনাদের কাজ বাড়লো। আপনার রোগীর জন্যও দোয়া করতে হবে, বৃদ্ধার জন্যও দোয়া করতে হবে।

রিনি দাসকে সিপ্যাপ দেয়া হলো। মেশিন সর্বোচ্চ প্রেশারে ধাক্কা দিয়ে অক্সিজেন পৌঁছে দিলো তাঁর ফুসফুসে। পুরো রাত ধরে ধীরে ধীরে তাঁর অক্সিজেন লেভেল বাড়তে থাকলো। সকালের ইসিজিতে সাব্বির দেখলো হার্টও ঠিকঠাক কাজ করছে! আমি বাসায় ফিরলাম রাত ৩ টার দিকে। আম্মা বললেন, 'এত রাত পর্যন্ত কী করলি?' আম্মাকে বললাম রিনি দাসের কথা। আম্মা নামাজ পড়ে দোয়া করলেন মেয়েটার জন্য।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং শামসুদ্দিন হাসপাতাল সমন্বয় করে পরেরদিন মেডিকেল বোর্ড হলো। সব ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন রিনি দাসকে। আলট্রাসনোগ্রাম করলেন ডাক্তার কান্তা নাহিদ। দেখা গেলো এই মহাপ্রলয়ঙ্করী রাত পার করেও শিশুটি এখনও বেঁচে আছে!

আমার ডিউটি শেষ হলো ১৪ তারিখ। তারপর ফয়সল কবির ভাই, তানভীর নাবিল মুসাসহ বাকিরা সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। রিনি দাসের অক্সিজেন চাহিদা ধীরে ধীরে কমে আসলো। এক মাস যুদ্ধের পর আজ তাঁর অক্সিজেন লাগছে মাত্র ১ লিটার। কালকেই হয়তো তাঁকে আমরা আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করে দেবো। তারপর আমরা অপেক্ষায় থাকবো সেই যুদ্ধজয়ী শিশুটির জন্য।

গত দেড় বছরে এখান থেকে কত মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরেছেন! তবে রিনি দাসের সুস্থ হওয়াটা আমাদের জন্য অতি বিশেষ একটি ঘটনা হয়ে থাকবে।

২.
এই গল্প লিখে রাখলাম। অনেক বছর পর আমার সন্তান যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের আইসিইউতে কি কখনও ভালো কিছু ঘটেনি?’ তখন এই লেখাটা দেখিয়ে তাকে বলবো সেই নন্দিত নরকেও মাঝে মাঝে স্বর্গের দূত নেমে আসতেন, তারপর তিনি নিজের হাতে লিখে যেতেন এইসব অপার্থিব গল্প।

ডা. আলিম আল রাজি: মেডিকেল অফিসার, কোভিড আইসিইউ, শহিদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতাল, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.