Sylhet Today 24 PRINT

আচ্ছা, আকাশ দেখতে না পারার দুঃখে কি কেউ আত্মহত্যা করে?

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

মিনহাজুল আবেদীন; বুধবার রাতে আত্মহত্যা করেছেন শাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী

মিনহাজুল আবেদীন; শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) গণিত বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ৩টার দিকে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সালামতপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন মিনহাজুল আবেদীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম সাইদুর রহমান বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে মিনহাজুলের আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কী কারণে আত্মহত্যা মিনহাজুলের সেটা জানা যায়নি এখনও। এদিকে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাত ১টা ৮ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস লিখেন মিনহাজুল আবেদীন। যেখানে তার জীবনের নানা দিক ওঠে আসে তার বয়ানে।

সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরের পাঠকদের জন্যে মিনহাজুল আবেদীনের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি প্রকাশ করা হলো:

আমার জন্ম পহেলা বৈশাখ। যেদিন বাঙালিরা বৎসরের আবর্জনা দূর করে মঙ্গল কামনা করে। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, বাইরে তখনও সব গ্লানি মুছে, সব জরা ঘুচে যাক এমন প্রার্থনা করে গান বাজছে। তখন আমার মাকে কয়েক ঘণ্টার তীব্র প্রসব বেদনা দিয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে দেখলাম আমি। মাতৃগর্ভের প্রবল নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ভালো লাগার কথা না, তাই কান্না করেছিলাম। শুনে অবশ্য ডাক্তার বলেছিল, ছেলের গলায় জোর আছে বেশি তেজি হবে।

আমার জন্মের ঠিক আগের দিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আকরাম খানের নেতৃত্বে আইসিসি ট্রফি জিতে ফেলে। পরবর্তীতে সেটার কারণে টেস্ট খেলার মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। তখনকার এই অর্জনে বেশ ভালো অবদান রাখেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, যিনি বর্তমানে প্রধান নির্বাচকের ভূমিকায় আছেন। আমার মামা বলেছিল, এই ছেলেও একদিন এমন বিশ্বের বুকে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। তাই উনার নাম অনুসারে আমার নাম রাখা হয় (অবশ্য নান্নু অংশটা বাদ দেওয়া হয়)।

আমার বেড়ে ওঠা যশোরের এক শান্ত শীতল অঞ্চলে। অবশ্য আমি আমার আশেপাশের সমবয়সীদের মত ডানপিটে ছিলাম না। আমার জীবন কাটতো আমার জগতে। বাবা মা দুজনই চাকুরীজীবী হওয়ায় তারা বেরিয়ে পড়তো কাজে, আর আমি একা একা খেলতাম আমার নিজের সাথে। সেই ছোট্ট থেকেই একাকীত্ব একটা ট্রমা হয়ে আছে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার কখনোই ভালো লাগতো না। তাই কখনো স্কুলে যাওয়ার পথে অর্ধেক রাস্তা গিয়ে কোথাও ঘণ্টাখানেক বসে থেকে চলে আসতাম। কখনো ভাঙা জানালার শিক খুলে পালিয়ে আসতাম। মা অবশ্য প্রায়ই বলত, স্কুল পালালেই নজরুল হওয়া যায় না। আমি অবশ্য নজরুল হতে চাইনি কখনো, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার থেকে পালাতে চেয়েছি।

তারপর স্কুল লাইফটা মোটামুটিভাবে পেরিয়ে গেলো। পেরিয়ে গেলো কলেজটাও। এই সময়ে আমি বিভিন্ন পরীক্ষায় বিভিন্ন সাবজেক্টে ফেইল করলাম আবার অনেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েও গেলাম। কলেজ লাইফের শেষের দিকে আমি একটা নির্মম সত্য প্রথমবারের মতো অনুধাবন করলাম যে আমার কোনো বন্ধু নেই। সেটা অবশ্য এখন পর্যন্ত সত্য। ঠিক সাদাত হোসাইনের কবিতাটার মত।

এরপর ভর্তি হলাম ভার্সিটিতে। প্রথমদিকে অবশ্য বেশ লাগতো। স্বাভাবিক নিয়মেই ফার্স্ট ইয়ারে বন্ধুদের একটা গ্রুপ জুটে যায়। যদিও সেটা এক সেমিস্টারের বেশি ছিলো না। এরপর শুরু করলাম রোবোটিকস কম্পিটিশন। লেখাপড়া সব শিকেয় তুলে পড়ে থাকতাম ল্যাবে। আর একের পর এক কনটেস্টে হারতাম। প্রতিবার হারার পর বলতাম এখানেই শেষ, আর না। তারপর আবার নতুন একটা কনটেস্ট নতুন উদ্যমে কাজ করা। এরপর অবশ্য একটা সময়ে জেতা শুরু করলাম। একে একে দেড় ডজন ন্যাশনাল কম্পিটিশন আর একটা ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনে জিতে গেলাম। আমাদের একটা টিম ছিল ৫ জনের। ২০১৯ এর পর আস্তে আস্তে টিমটা ভেঙে গেলো। তারপর বিভিন্ন কারণে একে একে প্রত্যেকটা টিম মেম্বারের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। পরে অবশ্য আমি ব্যক্তি উদ্যোগে বা অন্য কোনো টিমের সাথে অন্য আরও কিছু টেকনোলোজি নিয়ে কাজ করেছি।

এতদিনে আমি দেখলাম আমার পড়াশোনা সব মোটামুটি শেষ। এত বেশি ড্রপ জমে গেছে সেটা উঠানো সম্ভব না। তাই গ্র্যাজুয়েট হবো, এমন চিন্তা বাদই দিয়ে দিচ্ছিলাম। এরমধ্যে একটা স্টার্টআপ শুরু করি। চেষ্টা করি বাচ্চাদের কাছে টেকনোলজির কঠিন সব বিষয় সহজ করে তুলে ধরতে। সেখানেও অনেক উত্থান পতন ছিল। কিন্তু একটা শিক্ষা আমি অনেক আগেই শিখেছিলাম, কখনো থেমে গেলে চলবে না।

কিন্তু থামতে আমাকে হলোই একটা পর্যায়ে। আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি আবার পরীক্ষায় ফেইল করেছি অনেকবার। দুটোরই অনুভূতি কেমন সেটা আমার জানা। আমি খালি পকেটে পুরো শহর হেঁটেছি, আবার পকেট ভর্তি টাকা সেই শহরেই উড়িয়েছি। আমি টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করে দেখেছি, আবার টানা ১৮ ঘণ্টা ঘুমিয়েও দেখেছি। আমি তীব্র প্রেম অনুভব করেছি, আবার বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেছি। জীবনের অনেকগুলো দিক আমার দেখা হয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রেই আমি আসলে নিজেকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি আমার আসল অস্তিত্বকে। তাই মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদের মত আমি কল্পনায় আমার কবর দেখতে পায়। না, শ্বেত পাথরের না। জঙ্গলের জঞ্জালের ভেতর ছোট্ট ইট পাথরের একটা কবর। আর সেটার এপিটাফে লেখা "এখানে একটা নির্বোধ ছেলে ঘুমিয়ে আছে, যে মানুষকে ভালোবাসতো।"

হ্যাঁ, মানুষকে আমি ভালোবাসি। সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসি। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না কিংবা শীতার্ত বৃদ্ধার কাঁপুনি আমার মন খারাপ করিয়ে দেয়। মানুষের জন্য কাজ করতে আমার খুব ইচ্ছা হয়, তবে অন্য সব ইচ্ছার মত এটাও অপূর্ণ থেকে যাবে।

আমার জীবনটা বেশ ছন্নছাড়া ছিল বরাবরই। আর ছিল কিছু পুরনো ট্রমা। এগুলোর সাথে স্ট্রাগল করে মোটামুটি যাচ্ছিলো আমার জীবন। এরপর না চাওয়া প্রার্থনার মত আমার জীবনে আসলো অসাধারণ একটা বাবুই পাখি। বাবুই পাখিটা আমাকে দিলো আরাধ্য সব সুখ। তারপর একদিন হঠাৎ করে উপলব্ধি করলাম সেই বাবুই পাখিটা আর আমার সাথে নেই। কেন নেই সেই প্রশ্নের উত্তর অনেকবার খুঁজেছি অবশ্য। আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার শরৎ আকাশ ছেয়ে গেছে প্রলয় মেঘে। তারপর একটা ঝড় এসে তছনছ করে দিলো আমার সব কিছু।

মাঝখানে সিজোফ্রেনিয়া, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, সুইসাইডাল ওসিডির মত জটিল সব রোগ ঘিরে ধরল। এসব নিয়ে কতবার যে হাল ছেড়ে দিয়েছি, কতবার কোয়াইট করতে চেয়েছি সেটা কেবল আমি আর আমিই জানি। প্রতিটা ভোরে যে ট্রমা নিয়ে ঘুম থেকে উঠতাম আর যে ভয়াবহ প্যানিক অ্যাটাক নিয়ে ঘুমাতে যেতাম সেটা শুধু আমিই জানি। প্রতিটা দুপুর আমার কেটেছে ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট নিয়ে, প্রতিটা বিকেল কেটেছে একাকীত্বে আর প্রতি সন্ধ্যা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মত আক্ষেপে পুড়ে। আমি দেখেছি শুধুই সিলিং, নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমার জল কিংবা সুউচ্চ ভবনের ছাদ থেকে নিচের কাদামাটি।

এরপর দীর্ঘ দশ মাস পার হলো। তারপর আমি কি সামলে উঠতে পেরেছি? সবাইকে অবশ্য বলি আমি সামলে নিয়েছি। কিন্তু আমি তো এখনো বৃষ্টিতে ভিজতে পারি না। সুন্দর কোনো গান শুনতে পারি না। এখনো কাঁদতে পারি না। আকাশ দেখতে পারি না।
আচ্ছা, আকাশ দেখতে না পারার দুঃখে কি কেউ আত্মহত্যা করে?

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.