Sylhet Today 24 PRINT

হিরো আলমের ‘ভিকটিম কার্ড’ ও ‘নিচুতলার সেন্টিমেন্ট’

জিয়া আরেফিন আজাদ |  ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

DW চ্যানেলে ‘খালেদ মহিউদ্দিন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হল। সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার। বগুড়া উপ নির্বাচনের আগে গত কয়েক বছরে নানা কারণে হিরো আলম সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। সাধারণভাবে আমি যে কোনো অ্যাটেনশন সিকারকে উপেক্ষা করে চলি। হিরো আলম অত্যন্ত বুদ্ধিমান, উদ্যমী ও ফোকাসড একজন ব্যক্তি। নেগেটিভ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে তিনি নিজের কাটতি এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। এই কাজে তাকে সহায়তা করাটা উচিত মনে হয়নি।

গত বছরের মাঝামাঝি রবীন্দ্র সংগীত বিতর্কের পর থেকে তার ক্যাম্পেইন ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করলো। সংবাদ সূত্রে জানা যায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল মূলত বিনা অনুমতিতে পুলিশের পোশাক ব্যবহার করায়। সেখানে কাস্টডিতে তাকে নানা অপমানসূচক কথা বলা হয়। রবীন্দ্র বা নজরুল সংগীত না গাওয়ার মুচলেকা পুলিশ করেছে নিজ দায়িত্বে।

আমরা সকলেই জানি আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী একটি গোষ্ঠি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আধুনিক পোশাক ও চালচলনের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া সব কিছুতেই নেতিবাচকতার একটা বিষয় রয়েছে। সুবিধাবাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেরা প্রত্যক্ষ রাজনীতি করবে না। তারা সুযোগের সন্ধানে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তার। কেউই সিস্টেমের বাইরে ছিটকে পড়তে চায় না। তাই অন্যের লেজ দিয়ে কান চুলকানোটা আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।

আগে মানুষের চক্ষুলজ্জা ছিল, জাসদ-সর্বহারাকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে খেল দেখত। তারপর ধীরে ধীরে ফ্রিডম পার্টি, প্রগশ, জাগপা থেকে জঙ্গি-মঙ্গি আরও নানা রকম কেউটে সাপ মাঠে ছাড়া হতে থাকলো। ক্ষমতার মেশিনারি যারা চালান তাদের হাতে অনেক রকম ইনস্ট্রুমেন্ট আছে। আছে বহু স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির। তাই প্রক্সি ওয়ার বেশিক্ষণ কাজ করে না। এক আছে সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উন্মাদনা। এই কার্ড কখনও বিফল করে না। তবে অতীতে যেমন সেই কার্ড কারো একচেটিয়া ছিল, এখন তা নয়। তাই দাবার ছকটা বড় গোলমেলে হয়ে যায়।

যা বলছিলাম, ক্ষমতার রাজনীতি সাধারণভাবে নীতিহীন। আর আমাদের মত কুশিক্ষার দেশে সেটা নির্লজ্জতার শেষ সীমা ছাড়ানো। বিরোধীদের স্পেস দেওয়া হবে না। তারাও সত্যিকার সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে না। এই দুইয়ের টানাটানির প্রোডাক্ট হল ভিপি নুর। এই প্রকল্পের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ধেড়ে পরিকল্পনাবিদরা ভর করলো শিশু আন্দোলনের উপর। আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সততা না থাকায় প্রতিটা প্রক্সি ওয়ারই শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে।

ক্ষমতা বলয় থেকে ছিটকে যাওয়া উচ্ছিষ্টভোগপ্রত্যাশীদের সর্বশেষ দুর্গ হল আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। ইতিবাচকভাবে তাঁকে সমর্থন করলে আপত্তির কিছু দেখতাম না। মূলত বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রিডিকিউল করার জন্যই তারা হিরো আলমকে সমর্থন দিয়েছেন। এটা হিরো আলমের জন্যও অবমাননাকর। অবশ্য তার সেই বোধ আছে বলে মনে হয় না। তিনি নিজেকে শিল্পী বলে দাবি করেন। কিন্তু সেখানে তার সত্যিকার কোনো নিবেদন নেই। একজন কমেডিয়ান হতে গেলে যে মেধা ও রসবোধ থাকতে হয় তিনি সেই পথে নেই। নিজেকে ভালগারভাবে উপস্থাপন করে নানাভাবে আলোচনায় থাকতে চান। সেটা তার স্বাধীনতা। কিন্তু তিনি যে কাজটা খুব দক্ষতার সাথে করছেন তা হল ভিকটিম কার্ড খেলা। কোথাও বাধা পেলেই তিনি গরীব বা নিচুতলার সেন্টিমেন্টকে সামনে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের সুবিধাবাদি মধ্যবিত্তদের প্রিয় বিষয় হল ছদ্মবিপ্লব। মার্কেটে সিরাজ সিকদার বা বাংলা ভায়ের সাপ্লাই নাই। এখন হিরো আলমই ভরসা। এই সমর্থনকে নায্যতা দিতে তারা হিরো আলমের উপর নানা কাল্পনিক গুণাবলি আরোপ করতে থাকলেন। তিনি সৎ, তিনি প্রতিবাদি হ্যান ত্যান ইত্যাদি।

আজ জার্মান টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে আশরাফুল হিরোকে অত্যন্ত প্রত্যয়ী ও চৌকস মনে হচ্ছিল। তিনি কেন রাজনীতি করতে চান, মানুষ কেন তাকে ভোট দেবে ইত্যাদি প্রশ্নের তিনি খুব চিত্তাকর্ষক জবাব দিয়েছেন। তার মতে পঞ্চাশ বছর সবাইকে দেখা হয়েছে, মানুষ এখন নতুন কাউকে চায়। তাকে কেন চাইবে? কারণ, তিনি সৎ ও জনদরদী।

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে সঞ্চালক খালেদ মহিউদ্দিন হিরো আলমের হলফনামা হাতে নিয়ে তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। হলফনামা অনুযায়ী হিরো আলমের মাসিক রোজগার একুশ হাজার টাকা। তিনি যে বাড়িটি বানাচ্ছেন সেটার পিছনে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন বলে দাবি করলেন। তিনি শত শত মানুষকে সাহায্য করেন। প্রতি মাসে কত টাকা সাহায্য করেন এই প্রশ্নে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেললেন।

হিরো আলমকে যারা প্রমোট করে তারা নিজেরাও তাকে সিরিয়াসলি নেয় না। আগামীকাল যদি ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন হয় তা হলে তার কথা সবাই ভুলে যাবে। তিনি আলোচনায় এসেছেন সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু মাঝখান থেকে একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিকে হিরো আলম সূচকে মাপতে গিয়ে আমাদের যুব সমাজের কাছে খুব খারাপ একটা বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে। এর অর্থ হল, রাজনীতিতে সকলেই অসৎ। সকলেই অযোগ্য। আর সততা ও নৈতিকতার অন্যতম উদাহরণ হলেন হিরো আলম। বাংলাদেশের প্রতিকূল সমাজে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক, নারী জীবন সংগ্রামে তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছেন, উৎপাদন ব্যবস্থায় অবদান রাখছেন, নানা প্রলোভন সত্ত্বেও সৎ রোজগার ও আইনসিদ্ধ জীবনযাপন করছেন। হিরো আলমকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে প্রচার করা তাদের সকলের প্রতি এক চরম চপেটাঘাত। হিরো আলমকে মুখে বলা হচ্ছে গরীবের প্রতিনিধি। কিন্তু তিনি আমাদের হিপোক্রিট এলিট শ্রেণির অবদমিত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বর্জ্য মাত্র। তার মধ্যে কোনো মহত্তর আকাঙ্ক্ষা নেই। আছে কেবল লোভ। সামান্য বিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকা কামাই করেই তিনি হিসাব দিতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। কোটি টাকার হাতছানি দেখলে নিজেকে সামলাবেন কীভাবে?

হিরো আলমকে দিয়ে আসলে আমাদের নিজেদের চেহারা চেনা যায়। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আমরা কেউই সুখি নই। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষা হল অন্য কেউ এসে বা গায়েবি শক্তিতে এইসব অনিয়ম দূর করা। এভাবে হবে না। আমাদেরকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। মানুষকে ইতিবাচকভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে। বাধা আসবেই। নৈতিক শক্তি, একাগ্রতা আর সঠিক নেতৃত্ব থাকলে লক্ষ অর্জন কঠিন হবে না। নিজে কিছু না করি, আমাদের কারোই উচিত নয় পাবলিকলি হতাশা ও নেতিবাচকতার প্রচার করা বা অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়কে মকারিতে পরিণত করা। জীবন একটা সংগ্রাম। প্রক্সি ওয়ার দিয়ে সেটাকে অ্যাভয়েড করা যায় না। সে কাজ করতে চাইলে হিরো আলমের মত এমন অ্যাবরশনই বার বার ঘটবে।

  • জিয়া আরেফিন আজাদ: শিক্ষক।
  • লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.