Sylhet Today 24 PRINT

নারী দিবস ও আমার আত্মজীবনী ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি |  ১১ মার্চ, ২০২৩

আমার বইয়ের তিন নম্বর এডিশন মার্কেটে গেছে প্রায় পনেরদিন আগে। মেলায় উপস্থিত না থেকেও, বইমেলা থেকে ব্যান হয়েও আমার বইয়ের ব্যাপারে প্রতিদিন গড়ে বিশজন জানতে চান—বইটা কোথায় পাওয়া যাবে? এটা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা নেয়ার আছে। শিক্ষাটা হচ্ছে—যারা অনলাইনে গলাবাজি করে তারা বই তেমন পড়ে না। যারা পাঠক তারা বই পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা খুঁজবেই আপনি কী এমন লিখেছিলেন যার ওপর প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ক্ষেপে গেছে!

আমার বইটা বইমেলা থেকে ব্যান হইছে এবং সেই সময় থেকে শুরু হইছে মহাভারতের মতো বিশাল আলাপ। সেই আলাপ হওয়া উচিত ছিলো বইটা ব্যান করা যায় কিনা? ইয়েস অর নো। বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলে অবশ্যই—নো। কিন্তু আমাদের শেখানো হয়েছে—নারীর লেখা আত্মজীবনী হতে হবে স্বস্তিদায়ক। কারোর নাম নেয়া যাবেনা, কোন ঘটনায় কে আছে তা লেখা যাবে না, অন্যের মুখে শোনা গল্পও লেখা যাবে না। কিন্তু, লেখা যাবে না কেন?

কারণ—তাতে অনেকের মুখোশ ধরে টান দেওয়া হয়। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা চায়—আপনি নারী হিসেবে হট্টগোল করতে পারবেন না। আপনার কথা বলতে হলে পুরুষ হতে হবে। মেয়েমানুষ হয়ে এতো কথা কীসের?

আমার বিরুদ্ধে যারা ট্রায়ালের আয়োজন করেছেন তাদের একটা মজার ব্যাপার আছে। প্রথমে আমাকে বলা হলো—আমি প্রাইভেসি ভেঙেছি। প্রশ্নটা হলো—কার? যখন আমি জানালাম—আমার নিজের, তখন তারা আমাকে বলতে শুরু করল, আমি ইউরোপের প্রাইভেসি আইন ভেঙেছি।

যখন আমি জানালাম—ইউরোপের মি-টু আন্দোলনের কথা, ক্ষমতাধরদের নাম নেয়ার কথা, তখন শুরু হলো—আমার চরিত্র কতো খারাপ। তা এই চরিত্র খারাপের সংজ্ঞা কারা বানিয়েছে?

উত্তর হলো—যারা নিজেরা নানান কুকর্ম ইনবক্সে করে রেখেছে। যারা ভয় পায়—এই বইটা নিয়ে পজিটিভ কিছু লিখলে সাহস করে আরেকটা মেয়ে এগিয়ে আসবে নিজের কথা বলতে! অতগুলো মেয়ের মুখ ওরা সামলাবে কেমন করে?

অবশ্য নারীর আত্মজীবনী অস্বস্তিকরই হবে। একশো বছরের কিছু বেশি সময় আগে যে ভূখণ্ডে নারীদের চিতায় তোলা হতো সহমরণের জন্য সেখানে একজনকে আত্মজীবনী লেখায় ছেড়ে দেয়া হবে—এই আশা আমি করিনি।

আরেকটা ব্যাপার হলো—বইয়ে যৌনতার আলাপ আছে। যৌনতা এক ধরনের রাজনীতি। আমাদের উপমহাদেশের কালচারে এসব বিশাল ট্যাবু। আমাদের মেয়েরা তাদের যৌনতার ব্যাপারে কথা বলবে—এটা আমাদের সংস্কৃতিতে নির্লজ্জতা দেখা হয়।

হ্যাঁ, আমি জানাতে চাই মেয়েদের যৌনতার অনুভূতি আছে, তাদের জীবনে সেসব নিয়ে অভিজ্ঞতাও আছে। একটা অদ্ভুত প্রশ্ন হলো—আপনি মিউচুয়ালি একজনের সাথে থাকার পরে সেকথা কেন লিখবেন?

এটা ভুল কথা। আপনার এড্রেস করা দরকার ছিলো ঠিক কী কারণে পুরুষরা এইসব মিউচুয়াল কিংবা প্রিভিলেজপ্রাপ্ত কর্মকাণ্ড লুকাতে চাইছে। লুকাতে চাইছে কারণ ওরা জানে, লুকিয়ে আনন্দে থাকা যায়। লুকিয়ে কল্পিত 'চরিত্র' সংরক্ষণ করা যায়। সমাজে ইজ্জত পাওয়া যায়।

আমার মতে চরিত্রের ধারণাই ভুয়া। মানুষের চরিত্র মানুষের কর্মে। আমাদের দেশে সঙ্গম করা চরিত্রের খারাপ দিক কিন্তু ঘুষ খাওয়া খারাপ না। কেন? কারণ যৌনতা ট্যাবু, কিন্তু ঘুষ খাওয়া ট্যাবু না!

আমি মনে করি না—লেখকের আলাদা চরিত্রের দরকার আছে। লেখক ভালো মন্দ মিশিয়ে মানুষ। লেখক আপনার কল্পিত ফেরেশতা না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি দেখেছিলাম—দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় কিছু লোকজন বলতো— আমি বিচার চাই, কিন্তু... আমার ক্ষেত্রে এই একই ধরনের লোকদের আচরণ—আমি চাই বই ব্যান না হোক, কিন্তু...

'কিন্তু' একটা এমন শব্দ যেটা বলে অন্যায়কে টিকিয়ে রাখা যায়।

অথচ আমাদের অবস্থান হওয়া উচিত—যত বিরুদ্ধ মতেরই হোক, 'কিন্তু' বলে একটি বইও ব্যান করা যাবে না।

শোনেন, আমি একদিন যখন কলেজে পড়তাম, ২০১৩ সালে ষোলো বছর বয়সে আপনাদের বেশিরভাগের মতোই ছিলাম। সেই ষোল বছর বয়সে আমি বিশ্বাস করতাম, আমি যা বলছি সেটাই রাইট। ২০১৩ সালে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজশাহীর আলুপট্টির মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম তখন আমার মনে হতো মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আমি বিশ্বাস করতাম আমার চেয়ে বেশি কেউ বোঝে না। আমি সেই জায়গা থেকে সরে এসেছি অনেক আগেই।

২০২৩ সালে আমি দেখেছি—মব মেন্টালিটির প্রতিফলন হওয়া রায় খুবই জঘন্য। এর মানে হচ্ছে, বিচার না থাকা। আমি নিজে আদালতে দাঁড়িয়েছি টানা দেড় বছরের কাছাকাছি, একটা সত্য কথা লেখা ফেসবুক পোস্টের জন্য! কেন?

কারণ স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে লেখায় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। যে জিনিস প্রমাণিত, সেই জিনিসের জন্য কাউকে আদালতে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে কেমন লাগে সেটা আমি জানি।

কঠিন অপরাধী হলেও মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে আমি আর নাই একেবারেই। একজন আমার ঘর জ্বালায়ে দিলে আদালতের কাছ থেকে বিচার হিসেবে আমি বড়জোর তারে একটা ঘরে (জেলে) বন্দি রাখতে পারি যাতে সে বাকিদের ঘরের ক্ষতি না করতে পারে। এইটুকুই। কিন্তু তারেও জ্বালায়ে দিলে তার সাথে আমার পার্থক্য কই?

বলে রাখি—লেখকেরও প্রিয় লেখক থাকে, আর্টিস্টেরও প্রিয় আর্টিস্ট থাকে, যার কাছ থেকে সে শেখে। প্রিয় শত্রুও থাকে, যার কাছে সে শেখে শত্রুতার নতুন আইডিয়া। খারিজ করে দেয় না। মুখে শত্রুতা করে, কিন্তু মনে মনে প্রশংসা করে!

আপনারা একটু বুঝতে শেখেন—লেখক আর তার লেখা এক জিনিস না। লেখা-আর্ট, লেখক-মানুষ। মানুষের জীবনে ভুল থাকে, ঠিক থাকে। লেখার জীবনে থাকে—পাঠক।

আপনারা বইটা নিয়ে যত কুৎসা গাইবেন, পাঠক ততবেশি কৌতূহলী হবে। মানুষের ধর্মই তার কৌতূহল।

ফ্রান্সের ইতিহাসে খুব বিখ্যাত একজন লেখক ছিলেন—জঁ জেনে। এনাকে নিয়ে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ জিতেও ফিরিয়ে দেয়া প্রথম লেখক জঁ পল সাত্র একটা বই লিখেছিলেন—পবিত্র জেনে। জেনে চুরি ছিনতাইসহ এমন কিছু নাই যা করেন নাই। কিন্তু জঁ পল সাত্র কেন তাকে বলেছিলেন পবিত্র? ভেবে দেখেন—জেনের লেখাই তাকে 'পবিত্র' বলতে বাধ্য করেছিল।

অসংখ্য পজিটিভ মন্তব্য পেয়েছি আমি, পেয়েছি নেগেটিভ মন্তব্যও। এমনকি আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ অলরেডি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছেন আমাকে আরও আঘাত করতে, আমাকে আরও নতুন নতুন সম্ভাষণে অভিযুক্ত করবেন, কিন্তু আমি জানবো আপনি তবুও কৌতূহলী অথবা ঈর্ষাকাতর। এমন একটা বই লেখার সাধ্য কার হয় যেখানে সবাই মতামত দেয়া শুরু করে নিজের থেকেই?

আমিতো আপনার পা ধরে বলিনি—ভাই, এটা পড়েন! আপনি কেন টাকা খরচ করে পড়ছেন?

ভাবেন ভাই, ভাবা প্র্যাকটিস করেন। ঈর্ষা আর ব্যক্তিগত আক্রমণ দিয়ে আমাকে হয়তো কষ্ট দিতে সফল হবেন, কিন্তু এই বইটা আপনি মুছতে পারবেন না। ব্যান করে না, জেলাসি দিয়েও না। কারণ—ইট অলরেডি মেড ইউ ক্রেজি!

আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। নারী দিবস পালন করবেন আর নারীর লেখা আত্মজীবনী সহ্য করতে পারবেন না—এমনটা আর করবেন না! এই নারী দিবসে আমার নিজের কাছে একটাই প্রতিজ্ঞা—The best revenge is saying what your society doesn't want to hear from you. So keep taking the revenge again and again, unless they hear it.

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.