ফরহাদ মজহার | ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক ভিডিও–বক্তব্যে যে মূল রাজনৈতিক বার্তাগুলো উঠে আসে, সেগুলো তার ভাষা ও অবস্থানের সারাংশ ধরে বিচার করা দরকার। তিনি কী বলতে চেয়েছেন—তার মূল রাজনৈতিক ভাবনা ও উদ্দেশ্যগুলো আমাদের বুঝা দরকার। এখানে একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পেশ করছি।
ড. ইউনূসের বক্তব্যের সারকথা সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট।
১. “সবাইকে একসাথে বসতে হবে”—অর্থাৎ জনগণকে বাদ দিয়ে তিনি উপরের স্তরের এলিটদের মধ্যে তিনি সমঝোতার ডাক তিনি বারবার বলেছেন—
• দেশে শান্তি চাই,
• বিভক্তি মুছে ফেলতে হবে,
• বিভিন্ন মত–দল–শ্রেণীর মানুষকে একসাথে বসে সমঝোতায় আসতে হবে।
তাঁর বক্তব্য জনগণের জন্য নয়, বিপরীতে সমাজের উপরের শ্রেণী অর্থাৎ লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণী ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট মহলের বয়ান। অধিপতি রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতা গঠনের আহ্বান। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে গঠনতান্ত্রিক শক্তির আবির্ভাব আমরা দেখেছি তাকে নস্যাৎ করবার প্রক্রিয়াকে সফল করবার তিনি আহ্বানই তিনি বারবার জানাচ্ছেন।
২. “স্থিতি ও শৃঙ্খলা দরকার”—অর্থাৎ তিনি গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে দমন ও ঠান্ডা করার আবেদন জানাচ্ছেন। তিনি বলেছেন—
• সবাই যেন উত্তেজনা কমায়,
• শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এগিয়ে যায়,
• দেশে “স্থিতি” ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে জরুরি।
এর মানে হলো: জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে যে আন্দোলনের শক্তি তৈরি হয়েছে, যে গণশক্তির আবির্ভাব আমরা দেখেছি তিনি তাকে দমনের ঘোষণা দিলেন। জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য আমরা যেন কোন আন্দোলন-সংগ্রাম না করি তিনি আমাদের সেই বার্তাই দিচ্ছেন।
৩. “শান্তি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়”—এটা একালের সাম্রাজ্যবাদের ভাষা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবাদী আন্তর্জাতিক কর্পোরেট ভাষা। তিনি বলেছেন—
• আমাদের উন্নয়ন দরকার,
• উন্নয়ন করতে হলে শান্তি দরকার,
• বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে।
এটি মূলত আন্তর্জাতিক দাতা ও কর্পোরেট শক্তি–বান্ধব উন্নয়ন–বয়ান।
৪. “দোষারোপ নয়”— এটা পরিষ্কার যে তিনি অপরাধীদের দায় আড়াল করবার তৈরি করছেন। ভাষ্য। তিনি বারবার বলেছেন—
• কাউকে দোষারোপ না করে এগোতে হবে,
• অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।
এটি স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় অপরাধ, লুট, বিচারহীনতা—এসবকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। তিনি পুরনো ব্যবস্থাই বহাল রাখতে চাইছেন।
৫. “জাতীয় ঐক্য দরকার”— এর মানে এলিট–সমঝোতাকে জাতীয় ইচ্ছা হিসেবে তিনি হাজির করতে চাইছেন। তিনি মনে করেন—
• জাতি গভীর বিভক্ত,
• এই বিভাজন দূর করতে “ঐক্যমত্য”–এর প্রয়োজন,
• এবং এই ঐক্যমত্য সৃষ্টির দায়িত্ব “উপরের পর্যায়ের নেতৃত্বের।”
এর পুরো মর্মার্থ হলো: উপর থেকে চাপানো এলিট ঐক্যমত্যকে জাতির অভিপ্রায় বা ইচ্ছা হিসেবে দেখানো।
৬. “সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু ধীরে–ধীরে”—মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ রাখার ইঙ্গিত। তবে তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তিনি গণঅভ্যুত্থানে ব্যক্ত জনগণের অভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন।
• রাষ্ট্রকে পুরোপুরি বদলে ফেলা সম্ভব বা প্রয়োজন নয়,
• বরং ধীরে–সুস্থে কিছু সংস্কারই যথেষ্ট।
অর্থাৎ, গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন বা প্রক্রিয়ার বদলে তিনি রক্ষণশীল, নিয়ন্ত্রিত ও অভিজাত শ্রেণির পছন্দের সংস্কার চাইছেন।
৭. “নেতিবাচক রাজনীতি নয়”— এ কথা বলে গণঅভ্যুত্থানের গঠনতান্ত্রিক চরিত্রকে তিনি অস্বীকার করেন। তার কথায় বুঝা যায়—
• সংঘর্ষ, আন্দোলন, চাপ—এসবকে তিনি “নেতিবাচক” মনে করেন,
• তিনি চান “সহযোগিতা” ও “সমঝোতা”।
এটি বিদ্যমান ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তরের জন্য জনগণের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক তৎপরতাকে তিনি অরাজনৈতিক/অপরিণত ইচ্ছা হিসেবে হাজির করেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিশাবে শান্তি, সহযোগিতা ও সমঝোতায় বয়ান হাজির করেন।
৮. “বিশেষজ্ঞ–নেতৃত্বাধীন সমাধান” রাজনৈতিক পরিসর থেকে জনগণের ভূমিকা সরিয়ে ফেলার প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা। তিনি বারবার বলেন—
• বিশেষজ্ঞ, গবেষক, নীতি–নির্ধারক, দায়িত্বশীল নেতারা বসে সমাধান দেবেন। এর সারকথা হলো: রাষ্ট্র গঠনে জনগণের সরাসরি কোন ভূমিকাকে থাকাকে তিনি প্রয়োজনীয় মনে করেন না।
ড. ইউনূসের বক্তব্যের সারমর্ম হলো—উপর থেকে পরিচালিত শান্তি–সমঝোতা–স্থিতির মাধ্যমে এমন একটি এলিট–ঐক্যমত্য গড়া, যেখানে আন্দোলনকারীদের শক্তি নিস্তেজ হবে, অপরাধীরা রেহাই পাবে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন–কর্পোরেট স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, আর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে জনগণ নয়—উপরের পর্যায়ের লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণীর নেতৃত্ব, বিশেষজ্ঞ ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী ।
আমরা গর্ত থেকে বের হতে গিয়ে আরও বৃহৎ গহ্বরে পতিত হলাম।