Sylhet Today 24 PRINT

ক্যান্সার রুখতে সিগারেট : বিভ্রান্তিকর সংবাদ ও এর বৈজ্ঞানিক ভুল দিক

আশরাফ মাহমুদ |  ১৯ নভেম্বর, ২০১৬

ইত্তেফাক পত্রিকার বিজ্ঞান বিভাগে একটি খবর ছেপেছে (এই লিংকে ক্লিক করুন) যাতে উল্লেখ করেছে যে ক্যান্সার রুখতে বেশি বেশি সিগারেট খাওয়ার জন্য এবং তামাক খেলে ক্যান্সারের জীবাণু (এই জিনিসটা আসলে কী? ক্যান্সার হয় যখন আপনার শরীরের ডিএনএতে সমস্যার কারণে নিজের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে, ভাইরাসের মতন জীবাণু নয়; তবে ভাইরাস আক্রমণে ডিএনএর ক্ষতি হওয়ার ফলে মিউটেশনের কারণে ক্যান্সার হতে পারে)। যাহোক, পড়ে আমার খটকা লাগলো। গুগল সার্চ করে পেলাম দুই বছর আগে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এই খবরটি।

যাহোক, পড়ে আমার খটকা লাগলো। গুগল সার্চ করে পেলাম দুই বছর আগে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এই খবরটি (এই লিংকে ক্লিক করুন) । ইত্তেফাকের খবরটি মূলত এই লেখাটি কিংবা অন্য কোনো বিদেশী অনলাইন লেখা থেকে চোথা মেরে দেয়া। যাহোক, আমি সেখান থেকে গবেষণার লেখকের নাম নিয়ে (Mark Hulett; Principal investigator বা প্রধান বিজ্ঞানী, মানে যার ল্যাব) গুগল স্কলারে গবেষণা পত্রের জন্য সার্চ দিলাম, এবং মূল গবেষণাপত্রটি খুঁজে পেলাম (এই লিংকে ক্লিক করুন)। এবং ঘটনা পরিষ্কার হলো।

তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যার আগে বলে রাখি যে আমার গবেষণা ক্যান্সার গবেষণা না, তবে বিজ্ঞানের একটি গবেষণা পত্র পড়ে কিছুটা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে, এই গবেষণাটিতে যে ধরণের টেকনিক ব্যবহার করছে সেটি আমরা আমাদের নিউরো-সায়েন্সে ব্যবহার করি।

১. ইত্তেফাক দুই বছর আগের এই খবর ছাপলো কেনো হঠাৎ করে এবং তারা দাবি করছে এটি সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া তথ্য। ভুল।

২. গবেষকরা তামাক থেকে একটি যৌগকে আলাদা করে (বলে রাখা ভালো যে প্রাকৃতিক ও সিগারেট ইত্যাদিতে কৃত্রিমভাবে মেশানো এইসব যৌগের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের উপরে; এর মধ্যে ক্ষতিকর যৌগ আছে প্রায় ৮০-১০০টি) সেটির প্রভাব দেখেছেন ক্যান্সার কোষের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ তামাক নয়, বরং তামাকের একটি উপাদানের প্রভাব আছে ক্যান্সার রোধে। সেই উপাদানটি হচ্ছে NaD1 (ইত্তেফাকে ভুল করে লেখা আছে এনওডি-১), যা কোষঝিল্লীর রিসেপ্টরের সাথে বেঁধে তার কাজ চালায়। ফলে একটি গবেষণাপত্রের মূল ফলাফলকে ভুলভাবে (গল্পের গরুর গাছে চড়ার মতন) পরিবেশন করা হয়েছে। যেমন আমরা জানি যে মদ খাওয়া ক্ষতিকর। কিন্তু রেড ওয়াইনের কিছু কিছু উপাদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক বলে দেখা গেছে। তাই বলে আপনি যেমন রেড ওয়াইন লিটারে লিটারে খেয়ে মাতাল হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না তেমনি তামাকের হাজার হাজার উপাদানের মাঝে একটি উপাদানের সীমিত ইতিবাচকের জন্য ধুমপান করা আত্মহত্যার শামিল।

৩. মূল গবেষকরা কোনো প্রাণী কিংবা মানুষের উপর গবেষণা করেন নি, ল্যাবে পেট্রি ডিশে করেছেন ক্যান্সার কোষের উপর। ল্যাবে পেট্রি ডিশে ইতিবাচক ফলাফল পেলেই যে সেটা ক্যান্সার রোধ করে এমন না। এইজন্য অনেক গবেষণা ক্লিনিক্যাল ফেইজ উত্তরণ করতে পারে না। ক্যান্সার মারাত্মক জটিল রোগ, তাছাড়া মানব দেহে হাজার উপাদান কোষের মিথষ্ক্রিয়া আছে। ল্যাবে পেট্রি ডিশে একটি উপাদান ক্যান্সার রোধ করলে সেটির জন্য ধুমপান করা অনেকটা গরুর গাড়ি দিয়ে নিজের বাগানবাড়ি পৌঁছতে পেরে চাঁদের যাওয়ার মতন অবাস্তব শোনায়। মাঝখানে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে।

৪. ধূমপানে ক্যান্সার হয় এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, গত ষাট-সত্তর বছরের গবেষণা আছে (এই লিংকে ক্লিক করুন), একটি গবেষণার কারণে আগের হাজার হাজার গবেষণাকে উড়িয়ে দেয়া বোকামি। এমনকি মেটা-অ্যানালাইসিস (যেটি শত হাজার গবেষণাকে একত্র করে ফলাফল ও উপসংহার টানে) করে-ও দেখা গেছে যে ধুমপান ও ক্যান্সারের যোগসূত্র। তাই ক্যান্সার রোধে ধুমপান বন্ধ করা আবশ্যক, ধুমপান করা নয়।

৫. ইত্তেফাকের খবর ২৭+ হাজারের-ও বেশি শেয়ার হয়েছে। কতো মানুষ ভুল জিনিস পড়ছে, এবং এটিতে মানব স্বাস্থ্য জড়িত। এর দায় নেবে কে?

৬. বাঙলাদেশের কতিপয় সাংবাদিকের না আছে বিজ্ঞান-লেখার জ্ঞান না আছে ইংরেজি লেখা সঠিকভাবে অনুবাদ করে বাঙলায় সঠিক তথ্য পরিবেশনের যোগ্যতা। খবর প্রকাশিত হয় একটি আর অজ্ঞতা এবং উদাসীনতার কারণে লেখা হয় বা অনুবাদ করা হয় আরেক রকম।

৭. গবেষণাটি ফান্ডিং করেছে Balmoral Australia Pty Ltd এবং Hexima Ltd নামক দুটি কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো সম্পর্কে আমি বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পাই নি। তবে একটি গবেষণা যখন কোম্পানি ফান্ডিং করে সেটি মোটামুটি রেড ফ্ল্যাগ। কোম্পানিদের স্বার্থ কিংবা মনোরঞ্জনের জন্য গবেষণাপত্রের ফলাফল বিকৃত ও ভুল পরিবেশনের নজির আছে (ষাটের দশকে চিনি কোম্পানিগুলো চিনির ক্ষেত্রে করেছিলো)।

৮. বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া মানে সংশয়বাদীর চোখে কোনো ব্যাপারকে দেখা। একটি গবেষণায় কিছু একটা পাওয়া গেছে মানেই সেটি ধ্রুব সত্য নয়। এমন অনেক নজির আছে যে এক গবেষণা অন্য গবেষণার সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল পেয়েছে। তাই অনলাইনে কিংবা গবেষণা পাওয়া গেছে দেখলেই বিশ্বাস করে বসবেন না, সজাগ ক্রেতা হিসেবে সার্চ করে দেখুন, বিস্তারিত জানুন। অনেক গবেষণা কার্যপ্রক্রিয়ায় প্রচুর ভুল থাকে বা ক্রুটি থাকে।

  • আশরাফ মাহমুদ : গবেষক, কবি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.