Sylhet Today 24 PRINT

বিদায় দিপু ভাই: আমরা বাংলাদেশকে সিরিয়া, আফগানিস্তান হতে দেব না!

শাহরিয়ার বিপ্লব |  ২৮ মার্চ, ২০১৭

অশ্রুসিক্ত জানাজায় রক্তিম বিদায় দিপু ভাই।

কিছুই লিখতে পারছি না। কোন কিছুই আসছে না। শুধুই স্মৃতি। কিছু স্পষ্ট। কিছু অস্পষ্ট। এলোমেলো। অগোছালো। রাতেই খবরটা পেয়ে হাসপাতালে যাই।

বিছানায় শুয়ে আছেন। সবাই ব্যস্ত। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আর্মি, দলীয় নেতা, কর্মী জনগণ।

এর ভিতরেই দিপু ভাই কি ঘুমাচ্ছেন? ডাকবো? ওমা নাকে তুলা। চোখের নীচে কানের কাছে লাল লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। গভীর ঘুম। মহা ঘুম। চিরতরের ঘুম।

দুপুরে যখন শিববাড়িতে গিয়েছিলাম পেশাগত কৌতূহল থেকে। আমাকেই দেখেই বলে উঠলেন, ভিতরে যাইও না, ওখানে যাওয়া নিষেধ।

তবু আমাকে যেতে দেখে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুকে বললেন, হারা জীবন খালি বিপদ ডাইক্কা আনে। যাও গিয়া মর গিয়া।

উনাদের ক্রস করে একটি বাসার উপরে গেলাম যেখানে পরিচিত বড়ভাইরা নিরাপদে অভিযান দেখছিলেন। সেখান থেকে দেখছিলাম সাংবাদিক বন্ধুদের এক্টিভিটিজ। দিপু ভাইকেও দেখছি সাংবাদিকদের সাথে কাজ করছেন। একজনকে দেখলাম দিপু ভাইয়ের কাঁধে ক্যামেরা রেখে ছবি তুলছেন।

বিকালে চলে আসি বালুচরে একটি বাসায় দাওয়াত খেতে। সন্ধ্যায় মুসলিম হলে অন্য একটি অনুষ্ঠানে। বন্ধু মানোয়ার যখন সংবাদটি দিল বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দৌড়ে যাই ওসমানীতে।

আমাকে সাবধান করে নিজেই মরে গেলেন? কিভাবে বিশ্বাস করি দিপু ভাই?

আপনি তো বোম্ব ডিস্পোজালের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এই বোমায় আপনাকে মরতে হলো। দুপুরের কথাগুলো কানে বাজছে এখনো। কত লাশ টেনেছি জীবনে। আপনার সাথেও বহুবার। হবিগঞ্জে থাকার সময় প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনায় আপনি আমায় ডাকতেন। আমার ডিউটি না থাকলেও আপনার কারণে আমাকে যেতে হতো। রাতের পর রাত আপনার টহল গাড়িতে আমি ডিউটি করেছি। আমার রুটিন মাফিক অন্য ডিউটি থাকার পরেও এসপি সাহেবকে বলে আমাকে হাইওয়ে পেট্রোলিংয়ের নাইট ডিউটিতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন শুধু আপনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে। আপনি বলতেন নিজের মানুষ পেলে বুকে সাহস বেশি পাই। আমিও ক্রাইম কন্ট্রোলের কাজ পেয়ে এনজয় করছিলাম নিজেকে। বড় ভাই থেকে পরে বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম।

সেই সময়কার আনন্দ সুখের দিনগুলো দ্রুত মনে পড়ছিল।

আমি সিলেটে আসার কিছু দিন পর আপনিও চলে আসেন। সিলেটের অনেক ঘটনার সাক্ষী আপনি। বার বার আমাকে বড়ভাই সুলভ শাসন করেছেন। আমার বিয়েতেও বড় ভাইয়ের মত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আপনার কোন কিছুই ঠিক ছিল না। দুঃখের কথাগুলো আমাকে বলতেন। আপনার আমার পরিচিত অপজিশনের ছেলেগুলো নেতাদের তেল মেরে মেরে ভালো ভালো পদে বসে আছে কিন্তু আপনি পজিশনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেও গুরুত্বহীন পদে বসে আছেন এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ থাকলেও কারো কাছে যাননি তদবির করতে। এ নিয়ে আপনাকে কিছু বললে আপনি আমাকে উলটা ঝাড়ি দিতেন; কিন্তু আজকে শাসন করে আজকেই চলে গেলেন। কিভাবে মেনে নেই। আমেরিকা থেকে আসার পরে আপনাকে বলেছিলাম চলে যান। শুধু আমি না। সারোয়ার ভাই, বিজিত দা সহ পরিচিত অনেকেই। আপনি রাগ করে বললেন, তোমার ব্যবস্থা করে দেই তুমি যাও। গিয়া দেখ কেমন লাগে।

দিপু ভাই, অকালে মৃত্যুর স্বাদ পেতেই বুঝি এসেছিলেন? বুকটা ভার হয়ে আসছে। মুখে দলা আসে। বমি বমি লাগছে। কেন দিপু ভাই। কত সঙ্গী সাথিকেই তো হারালাম। একসাথে ডিউটি করা অবস্থায় বন্ধু সার্জেন্ট করিমকেও হারিয়েছিলাম। ওর লাশ নিয়ে রাজারবাগে মিছিল করেছিলাম। লাশ নিয়ে রাজারবাগ থেকে আরিচা পর্যন্ত গিয়েছিলাম ইমোশনাল হয়ে।

আজ কেনই বা সিলেটে এলাম। আমার তো এখানে আসার কথা না। তবে কি আপনাকে এভাবে বিদায় দিতেই আসা। কফিন টানার জন্যেই কি ঢাকা থেকে আসা? আপনাকে কি চিরবিদায় দিতে দিলাম?

বুকের ভার কমছে না দিপু ভাই। আপনি তো নাইওরপুল মসজিদে প্রতিদিন নামাজ আদায় করতেন। আপনি না বলতেন আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে তদবির করবেন না। তবে কি মৃত্যুর তদবির করেছিলেন? কিভাবে মেনে নিই?

যদি কাঁদতে পারতাম। জোরে জোরে কান্না। গগনবিদারী কান্না, কিংবা চিৎকার। জোরে যদি চিৎকার দিয়ে একটি স্লোগান দিতে পারতাম। আকাশ বাতাস ফাটিয়ে যদি বলতে পারতাম, জঙ্গিবাদ মৌলবাদ -ধ্বংস হোক নিপাত যাক।।

দিপু ভাই, বিশ্বাস করুন আপনারা আমাদের ঋণী করে গেলেন। লাল সবুজের এই মানচিত্রকে আরো গাঢ় লাল করে দিয়ে গেলেন। সবুজ মাটিকে আরেকটু ভিজিয়ে দিয়ে গেলেন। এ ঋণ আমরা শোধ করবোই। এ দেশকে আফগানিস্তান সিরিয়া হতে দেবো না।

এ আমার দেশ। বাংলাদেশ। এ আমার মা। মায়ের আঁচলে যতই খামছে ধরুক জঙ্গিবাদের বিষাক্ত শকুন। শকুনের এ ডানা ভাঙবোই। এ আমাদের অঙ্গীকার!

  • শাহরিয়ার বিপ্লব: পুলিশ কর্মকর্তা।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.