Sylhet Today 24 PRINT

আমরা প্রকৃতই ‘ভোতা’ হয়ে গেছি

অম্বরীষ দত্ত |  ০৭ জুন, ২০১৭

ক'দিন ধরে মনটা খুব খারাপ, ইদানিং যা প্রায় নৈমিত্তিক হয়ে গেছে, গা সওয়া। আর খুব খুব করে মনে পড়ছে স্বচক্ষে দেখা একটা ঘটনা। আশির দশকের মধ্যভাগে শেষভাগে খালাম্মা মানে কবি সুফিয়া কামাল মাঝে মাঝেই সিলেটে এসে দিন কতেক থাকতেন, মেয়ের বাসায়, মানে রঞ্জুদার বাসায়।

তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল। আমরা সুযোগ পেলে যেতাম, বসতাম, কথাবার্তা হতো, নানা বিষয় আশয় নিয়ে- ঘুরেফিরে সমাজ রাজনীতি কুশাসন সুশাসন মুক্তিযুদ্ধ সামনে চলে আসতো। আমাদের আরেক মাসীমা মানে রঞ্জুদার মা বীণাপাণি চক্রবর্তী, শহরের পরিচিত মুখ, উনিও এসেছেন, খুব সম্ভব রাজশাহী থেকে অথবা লন্ডন থেকে। আশির দশকের শেষদিকে একদিন সন্ধ্যায় সস্ত্রীক গিয়েছি রঞ্জুদার বাসায়। ঠিক সন্ধ্যায়। ত্রি-সন্ধ্যা যাকে বলে। মাগরিবের নামাজের সময়। পুরো বাসা নীরব, কোন কথা বার্তা শুনা যাচ্ছে না। দরজা খোলা। যতদূর মনে পড়ে বৌদি মানে সুলতানা কামাল তখন থাইল্যান্ড বা হংকং নাকি পোল্যান্ডে মানে বিদেশে কোথাও গেছেন পেশাগত কারনে। দিয়া তখন খুব ছোট - ৫/৬/৭ বৎসরের বাচ্চা মেয়ে।

পরিবারের সদস্যদের সাথে কবি সুফিয়া কামাল

রঞ্জুদা বাসায় নেই- স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে। ভিতরে ঢুকলাম। রঞ্জুদার বাসার পুরনো ঘরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় এক পাশে একটা বর্ধিত কোঠা । ঠাকুর ঘর, গৃহ দেবতা, রঞ্জুদার মা শিষ্টাচারী ব্রাহ্মণ বিধবা, সন্ধ্যাবাতি ধূপধূনা জ্বালিয়ে ঠাকুরঘরে বসে সান্ধ্যপ্রার্থনা করছেন; বিপরিত প্রান্তে পশ্চিম দিকের বড় ঘরটায় খালাম্মা, কবি সুফিয়া কামাল - মাগরিবের নামাজ পড়ছেন। আমরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রঞ্জুদার চেম্বারে এসে বসতে না বসতেই আবার ভিতরে যাবার ডাক। তখন কি পারুলদি ছিল? আমি মনে করতে পারি না। খালাম্মা আর মাসীমা- দু'জনেই অনিন্দ্য সুন্দর শুভ্রকায় সদালাপী- দু'জনেরই বৈধব্য জীবন, দুজনেই সত্তরোর্ধ, দুজনেই ধার্মিক ভিন্ন বিশ্বাসে, প্রার্থনায় মগ্ন, কী অপূর্ব সে দৃশ্য, কোন সংঘাত নেই, কোন ক্লেদ নেই, কোন কালিমা নেই, কোন দ্বিধা সংকোচ নেই, সে কী মিল দুজনের- আমি আজো ভুলতে পারিনা।

আর বৌদি, আপনিতো কেবলই বৌদি নন। যত কম দিনেরই হোক, শিক্ষাগুরুওতো, আমার বা আমার মত অনেকেরই। আপনার অন্তর আলোর খানিকটা আঁচতো আমাদের গায়েও লেগেছে। অথচ আমরা, সংস্কৃতি কর্মীরা, নাট্যকর্মীরা, সুশীলজনেরা , আপনার ছাত্র-ছাত্রীরা কী আশ্চর্য নীরবতা পালন করছি, কোন বিকার নেই আমাদের ! আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, জীবনচেতনার সাথে, রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই হয়ত মিল নেই আমার বা আমাদের, তাই বলে এমন অসহ সময়ে, ভয়াক্রান্ত সময়ে, এমন দহনের কালে আপনার পাশে দাঁড়ানোর কোন দায় নেই আমাদের ! কি করে সম্ভব ? আমার পাপ মার্জনা করবেন ম্যাডাম। আমরা প্রকৃতই 'ভোতা' হয়ে গেছি।

আমি শুধু ভাবি, আমাদের দু'জন মাসীমা জীবিত থাকতেন যদি আজকে, কেমন হতো তাঁদের ব্যক্তি-অনুভুতি? তাঁরা কি খুব কষ্ট পেতেন? রুষ্ট হতেন? মিথ্যাচারী মানুষের প্রতি? তাঁদের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠা নিকটজনদের প্রতি? ভ্রষ্ট সমাজের প্রতি?

(ফেসবুক থেকে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.