Sylhet Today 24 PRINT

আগাম সতর্কতায় বাংলাদেশে রক্ষা পেয়েছে হাজারো প্রাণ

সজীব ওয়াজেদ জয় |  ২৭ জুলাই, ২০১৭

সাইক্লোন মোরার প্রভাবে গত ৩০ মে’র ঝড়ে বাংলাদেশে ভূমিধস হয়। প্রচণ্ড বাতাস ও ঝড়ে কৃষি জমি ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত দুর্যোগের কথা তুলে ধরে গণমাধ্যম। কিন্তু স্বল্প প্রাণহানির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এতে নিহত হয় মাত্র নয়জন। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিশেষ বিশেষ স্থাপনার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতাকে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জনগণের জান-মাল রক্ষায় বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের রয়েছে সাফল্য। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উষ্ণ পানি অভিমুখে। তাই প্রতিবছর এখানে প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি এবং এর ১৬ কোটি মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের ৪০ ফুটের সামান্য ওপরে বসবাস করে। ফলে বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের বেশ কয়েকটির শিকার হয়েছে।

১৯৭০ সালে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে আনুমানিক তিন লাখ লোক নিহত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ তার আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে শুরু করে। আগের চেয়ে অধিক সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ এবং লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা উন্নত করা হয়। উপকূলে বাঁধ নির্মাণ ও অতিরিক্ত বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ‘বনবেষ্টনী’ সৃষ্টি করা হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোর ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি পরিকল্পনার অন্যতম স্তম্ভ হলো ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি, যা প্রণীত হয় বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও বাংলাদেশের ক্রিসেন্ট সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে। এই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ তার নাগরিকদের ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে অবহিত করে। সরকার ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ সংকেত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং সভা-সমিতি, আলোচনা, পোস্টার, লিফলেট, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও ব্যক্তি পর্যায়ে তত্পরতাসহ তথ্য প্রচারে নতুন নতুন পদ্ধতি চালু করে। এসব উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা লাখো-কোটি মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে এবং বিগত বছরগুলোতে বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হয়।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে এটি আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা যা বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক আবহাওয়া রাডার স্টেশন দ্বারা চালিত হয়। ঢাকা, খেপুপাড়া ও কক্সবাজারে অবস্থিত এসব স্টেশন আঘাত হানার বহু আগেই সম্ভাব্য প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় শনাক্ত করে প্রতি মিনিটে আবহাওয়া সংক্রান্ত সর্বশেষ বুলেটিন প্রচার করে থাকে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের কয়েকটি উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বয়ে যাওয়ার পর এই আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থাটি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করা হয়। প্রচণ্ড গতিতে বয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় দ্রুত সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। তাই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিন লাখ মানুষকে মুহূর্তেই সরিয়ে নেওয়া হয়, এতে হাজারো মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়।

দ্রুত বিশাল সংখ্যক সাইক্লোন সেলটার নির্মাণে সফলতা বাংলাদেশে দুর্যোগের প্রস্তুতিতে সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০০৭ সালের আগে বাংলাদেশে পাঁচ হাজার করে মানুষকে আশ্রয় দিতে সক্ষম ১ হাজার ৫০০ সাইক্লোন সেলটার ছিল। এরপর আরও ২ হাজার সেলটার বানানো হয়েছে। পাশাপাশি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় সুচিন্তিতভাবে বনায়ন করার বিষয়টিও সাইক্লোনের ক্ষতি কমাতে সক্ষম হয়েছে। সিডরের সময় এই ম্যানগ্রোভ বনভূমিই এই এলাকার জমিগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। মৃত্যু কমিয়েছে। এখন আরও ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী ম্যানগ্রোভ বনায়নের কাজে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা ব্যস্ত রয়েছেন।

২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি ও তার সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রতীরবর্তী মানুষকে রক্ষার বিষয়টিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো ও ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়ে রূপ দেন। এই মন্ত্রণালয়ের ওপর মানবিক সহায়তা কর্মসূচি পরিচালনা এবং জরুরি সাড়া দিতে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর গৃহীত কর্মসূচির সমন্বয়সহ ঝুঁকি হ্রাসমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।

তবে দুর্যোগ সংক্রান্ত পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে। গত জুনে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভূমিধসে ১৬০ জনের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। যে অঞ্চলে এই দুর্যোগ ঘটেছে সেটি ‘পার্বত্য অঞ্চল’ হিসেবে পরিচিত। এখানে অতি উন্নয়ন হয়েছে এবং এখানকার গাছপালা উজাড় করে ফেলা হয়েছে।

সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ভালো। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের আগ্রহ ও অধিকতর মনোযোগী হওয়ায়।

  • সজীব ওয়াজেদ জয়: প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.