Sylhet Today 24 PRINT

১২ মিনিটের ভিডিও: সমস্যা যেখানে

সানী সানোয়ার |  ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮

মেয়েরা উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপান করতে পারে কি পারে না – এটা নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। নির্মাতা বলছেন যে, পারে না। ব্যস, এ নিয়ে শুরু হয়ে গেল এক মহাবিতর্ক। ইদানিংকালে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সামাজিক সচেতনতামূলক ‘মিনি ভিডিও ড্রামা’ –‘ বৈষম্য’ নিয়ে কথা বলছিলাম। বিতর্কিত এই ভিডিওটি এখন নাকি ভাইরাল। নাকি ভাইরাল করার জন্য বিতর্কিত করে বনানো হয়েছে?

অবশ্য, ভিডিওটিতে আবেগের বহি:প্রকাশ দেখে মনে হয়েছে এতে যা দেখানো হয়েছে তাতে নির্মাতার মনের কথারই প্রতিফলন ঘটেছে, কোন ‘বিতর্ক ব্যবসা’ নয়। এদিক দিয়ে নির্মাতাকে সৎ বলেই মনে হয়েছে। তিনি একটা মানসিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই এটা বানিয়েছেন।

প্রবলেমটা অন্য জায়গায়:
গোড়াতে যদি গলদ থাকে তাহলে শিল্পচর্চা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার স্পষ্ট উদাহরণ এই ‘বৈষম্য' নামের ইউটিউব ভিডিওটি। প্রায় ১২ মিনিটের এই ছোট্ট নাটিকাতে লেখক মনের অজান্তে একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র নারী সমাজকে জড়িয়ে ফেলেছেন। আমার ধারণা এরকম অসংখ্য ভিডিও অনলাইনে রয়েছে যেগুলোর কোন শিল্পগুণ বা যৌক্তিক ভিত্তি নেই। অথচ, এগুলো লাখ-লাখ ভিউয়ারস দেখছে এবং সেগুলো থেকে অনেকের কাছে ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে কিংবা সেগুলো থেকে ভুল শিক্ষা নিচ্ছে।

স্নেহের অনুজ সালমান মুক্তাদির এবং মাসরুফ হোসেন—এর দু'টা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হল। এরপর ভিডিওটি ইউটিউব থেকে দেখে নিলাম। দেখে বেশ অবাকই হলাম। এতটা নিম্নমানের কনসেপ্ট, বিশ্লেষণ এবং স্ক্রিপ্টের এই ভিডিওটি ইতিমধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার ভিউস হয়ে গেছে। কিভাবে সম্ভব!!!!

এখন বলছি কি আছে এই ১২ মিনিটের ভিডিওটিতে?

এক মেয়েকে উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপান করতে দেখে একজন মা অবাক হয়ে তাকে ভর্ৎসনা করতে থাকেন। পাশে বসে থাকা একটি ছেলে (যুবক) মা'র এই বিরক্তি এবং ঘৃণা দেখে কিছুটা বিব্রত হয়। পরবর্তিতে ধূমপানরত বন্ধুদের সাথে এক যুবক আড্ডা দিতে গিয়ে উন্মুক্তভাবে এক মেয়েকে ধূমপান করতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এই দৃশ্য দেখে তার মনের বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। সে নিজেও একটি সিগারেট ধরিয়ে (অনিয়মিত ধূমপায়ী হিসেবে) বন্ধুদের কথায় কর্ণপাত না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপানের অভিযোগে সে মেয়েটিকে শাসাতে থাকে। যুবকটি মেয়েটিকে কোন আবদ্ধ জায়গায় গিয়ে ধূমপান করার জন্য পরামর্শ (অনেকটা আদেশ) প্রদান করে। নানা খোঁড়া যুক্তিতে সে মেয়েদের সমঅধিকারের বিপক্ষে যুক্তি দেখায়। মেয়েটিও তার সপক্ষের যুক্তি দেখাতে থাকে। কিন্তু সবমিলিয়ে নির্মাতা প্রটোগনিস্ট হিসেবে এই যুবককেই দাঁড় করান। আর মেয়েটিকে এন্টাগোনিস্ট হিসেবে।

যাহোক, সামাজিক নৈতিকতার বিচারে উন্মুক্ত জায়গায় নারীর ধূমপানের কোন অধিকার নেই -এটাই এই ভিডিও'র উপজীব্য বিষয়। লেখক বা নির্মাতার মতে নারীরা আবদ্ধ জায়গায় ধূমপান করবে, আর পুরুষরা যেকোনো জায়গায়। নিজেকে আধুনিকমনা বুঝাতে নির্মাতা নারীদের এতটুকু ছাড় দিয়েছেন যে, নারীদের ধূমপানে তার কোন আপত্তি নেই।

নির্মাতার ধারণার গোড়ায় যে গলদটি রয়েছে সেটা হচ্ছে নারী এবং পুরুষের ধূমপান করার উদ্দেশ্য অভিন্ন নয়। তার মতে নারীরা ধূমপান করে স্মার্টনেস শো করার জন্য, কিন্তু ছেলেরা কেন করে তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে ছেলেদের যেকোনো জায়গায় ধূমপানের বৈধতা তিনি দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যটি দেশের প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ বিপরীত:

প্রথমত: উন্মুক্ত বা আবদ্ধ যে কোন পাবলিক প্লেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ; সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন

দ্বিতীয়ত: নারীর এবং পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরতে গিয়ে তিনি নারীর সাংবিধানিক অধিকারের বিপক্ষে হেঁটেছেন, এবং

তৃতীয়ত: নারীদের ধূমপান করার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে প্রকাশ করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন। ফলে এটা নারীদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটাতে এবং ঘৃণা থেকে সৃষ্ট অপরাধ (Hate Crime) বাড়াতে অনেকটা প্রভাবিত করবে।

মূলত: আধুনিকতার দোষে মেয়েদের দোষী সাব্যস্ত করে বানানো এই ভিডিওটি মধ্যযুগীয় কায়দায় নারীদের শোষণের একটি হাতিয়ার ছাড়া কিছু নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এই নির্মাতা পার পাবেন না। কেননা, এখানে সামাজিক বৈষম্য, ঘৃণা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উপাদান ছাড়াও কিছু বেআইনই কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

এই ধরণের ভিডিও ‘ভাইরাল ব্যবসা’ বন্ধ করতে দেশের প্রচলিত আইনই যথেষ্ট। কেউ মামলা করলে ফেঁসে যেতে পারে এই ধরণের আরও অনেকে ভিডিও নির্মাতা।

তবে, ভাবনার ভিত্তি মজবুত হলে সাধুবাদ পাবার মত একটি কাজ হত এই ভিডিওটি। আগামীতে আরও ভাল কনসেপ্ট এবং স্ক্রিপ্ট আশা করছি।

  • সানী সানোয়ার: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার।

[লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.