Sylhet Today 24 PRINT

আপনার এলাকায় মাশরাফি দাঁড়ালে কি ভোট দিতেন না?

আরিফুল ইসলাম রনি |  ১৬ নভেম্বর, ২০১৮

বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানতে, এমনকি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে ডাকতে, ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও এই দেশে অসংখ্য মানুষের বাধে। তাই মাশরাফি বঙ্গবন্ধুর দলকে বেছে নিলে, অনেকের গাত্রদাহের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি!

শুধু মার্কা বা দলের কারণে যাদের ভেতর জ্বলছে, তাদের নিয়ে বা তাদের জন্য কোনো কথা নেই। তবে যারা সত্যিকার অর্থে মাশরাফির শুভাকাঙ্ক্ষী, তার জন্য নিখাদ ভালোবাসা আছে, তাদের মধ্যেও যারা দ্বিধা-সংশয়ে আছেন, তাদের জন্যই সুদীর্ঘ এই খেলা।

মাশরাফি কেন আওয়ামী লীগকে বেছে নিয়েছেন? যতটুকু ওকে কাছ থেকে দেখা, মেশা, জানার সুযোগ হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝি, কারণটা সিম্পল। মাশরাফি বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের পরিচয়ের মাধ্যমও বঙ্গবন্ধু।

এখন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে কতটা সরে এসেছে, কিংবা নেতাদের অনেকে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেন না, এসব বলে-টলে আপনি-আমি আঙুল তুলতে পারি। গালাগাল করতে পারি। ব্যস, আমাদের দায় শেষ! কিন্তু একজন মাশরাফি মনে করতে পারেন, দায়টা আরও বড়। সেই তাড়নাই তাকে তুলে দিয়েছে নৌকায়।

সেই নৌকা কোন পথ বেয়ে, কোন শাখা-প্রশাখা ছুঁয়ে, কোন ঘাটে ভেড়াবেন, সেটি তিনি খুব ভালো করেই জানেন। তার আত্মবিশ্বাস আছে, সদিচ্ছা আছে। তিনি নিজের কাছে পরিষ্কার। তার লক্ষ্য স্পষ্ট, দৃষ্টি নিবদ্ধ।

আমি তাকে চিনি বলেই আজ খুব আক্ষেপ হচ্ছে। কেন আমি নড়াইল-২ আসনের ভোটার নই! ‘অমুক ভাইয়ের দুই নয়ন, তমুক জায়গার উন্নয়ন’-আমাদের যে কোনো নির্বাচনে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় স্লোগান এটি। অনেক ট্রলও হয় এটা নিয়ে। অথচ নড়াইলের মাশরাফিকে নিয়ে এই স্লোগান হলে, সেটি হবে শতভাগ সত্যি!

বার তিনেক তার সঙ্গে নড়াইল যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। নড়াইলের পথে বের হলে মাশরাফি কেমন অস্থির হয়ে ওঠেন! কখনও রোমাঞ্চে, কখনও অপ্রাপ্তিতে, কখনও সম্ভাবনায়। নড়াইলের আলো-বাতাস, নড়াইলের স্বাদ-গন্ধ, প্রতিটি ধূলিকণা তিনি অনুভব করেন পূর্ণ অস্তিত্বে। রোমাঞ্চ থাকে সেসব নিয়েই।

আর অপ্রাপ্তি ও সম্ভাবনাগুলোও তার কণ্ঠে, তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে একসঙ্গেই। ‘এখানে এটা নাই, ওটা দরকার’, ‘ভাই, এই জায়গায় এমন কিছু করা যায়, ওই জায়গায় অমন করা যায়’… ইত্যাদি ইত্যাদি।

নড়াইল যাওয়া ছাড়াও রোজকার আড্ডায় হাজারও দুষ্টুমি-ফাজলামোর ভিড়ে কত শতবার শুনেছি নড়াইল নিয়ে তার ভাবনা, স্বপ্নের কথা! রাস্তায় একটু পথ পরপর রিকশাওয়ালা, পথিক, সাধারণ মানুষের জন্য খাবার পানির স্থায়ী ব্যবস্থা থাকবে। দু দণ্ড বসে জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। পাবলিক টয়লেট থাকবে। প্রতিটি রাস্তায় সিসিটিভি থাকবে। মেডিকেল কলেজ যদি একটা করা যায় কিংবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়! হাসপাতালটাকে এত বেডে উন্নীত করা গেলে! হাসপাতালে এই মেশিন, চিকিৎসার ওই যন্ত্র, ইমার্জেন্সি আরও উন্নত, আইসিইউ আরও আধুনিক, ডাক্তার-নার্সদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও সেবা নিশ্চিত করা, স্কুল-কলেজ-শিক্ষা ব্যবস্থায় কড়া নজরদারি, প্রশাসনে জবাবদিহিতা, বাল্যবিবাহ, কর্মসংস্থান, কৃষকদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, নড়াইলে গরীব-দু:খীদের খুব কাছের, একদম মাটির মানুষ হয়ে থাকা, কত কত ভাবনা যে তার কথায় উঠে এসেছে বারবার! জায়গায় জায়গায় অভিযোগ বাক্স থাকবে, সরাসরি দায়িত্বশীল কারও তদারকিতে। সিনেমার মতো লাগছে? অবাস্তব মনে হয়? তিনি ফ্যান্টাসিতে নয়, বাস্তবতা দিয়েই এসব ভাবেন।

গত ২-৩ বছরে নড়াইল নিয়ে তার এসব ভাবনার কথা অনেক বার শুনেছি। তাই বলে ভাববেন না, এত সময় ধরেই নির্বাচনের চিন্তা করছেন। নড়াইলের একজন হিসেবে, নড়াইলের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা থেকেই এসব ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে নিত্য। মাঝেমধ্যে নিজেকেই খুব ছোট মনে হতো তার এসব কথা শুনে, কারণ আমার নিজের এলাকা, নিজের জেলা, নিজের দেশকে তো আমি এভাবে হৃদয়ে রাখতে, এতটা ভালোবাসতে পারিনি!

স্বপ্নের টুকটাক কিছু বাস্তবায়ন আগেই শুরু করেছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন দিয়ে। ভালো কাজ করতে চাইলেও কতটা কঠিন এই দেশে, সেটি বুঝেছেন হাড়ে হাড়ে। তাই জানেন, আরও ভালোভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, আরও বড় পরিসরে, আরও দ্রুতগতিতে, আরও বিশদভাবে কাজ করার সুযোগ তাকে করে দেবে রাজনীতি।

মাশরাফির সত্যিকার শুভাকাঙ্ক্ষী বা তাকে সত্যিই মন থেকে ভালোবাসেন যারা, তাদের মধ্যে দ্বিধায় আছেন যারা, তাদের মূল প্রশ্ন যতটুকু বুঝেছি, ‘এখনই কেন? ক্রিকেট থেকে অবসরের পর করলেও পারতেন!’

মাশরাফিকে জেনে থাকলে আপনার অনুধাবন করার কথা, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের পর তার খেলার সম্ভাবনা এমনিতেও নেই বললেই চলে। তিনি নিজে তো সেটা ভালো জানেন! খেলেন কেবল ওয়ানডে ফরম্যাটই। সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের তিনটি ওয়ানডে আছে, ফেব্রুয়ারিতে নিউ জিল্যান্ডে তিনটি। মে মাসে আয়ারল্যান্ড সফর দিয়ে বিশ্বকাপের পথে যাত্রা শুরু। আয়ারল্যান্ড সফরের আগে ওয়ানডে আছে তাই কেবল ছয়টি। আপনার-আমার মানতে কষ্ট হতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

এখন ৬ মাসের জন্য ৫ বছরের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক? তার চেয়ে অনেক কষ্ট করে এই ৬ মাস দুটি একসঙ্গে ম্যানেজ করে, বাকি সাড়ে চার বছর উন্নয়নে ডুব দেওয়াই বেশি উপযুক্ত নয়? তাছাড়া, নির্বাচনের পর, দল ক্ষমতায় এলে, সরকার গঠন প্রক্রিয়া, সংসদ অধিবেশন বসা, সংসদীয় কমিটি হওয়া, এসব প্রক্রিয়ায় এমনিতেও কিছুটা সময় লেগে যাবে। বিশ্বকাপের আগে তাই খুব বেশি ঝামেলায় পড়ার কথা নয় তার।

হ্যাঁ, সবকিছুর পরও, নির্বাচন করলে এই কটা মাস ক্রিকেট সামলানো কঠিন হবে। অনেক অনেক কঠিন। বিশেষ করে নির্বাচনের ঠিক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ম্যানেজ করা হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অসংখ্য প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই তো আজকের মাশরাফি, এটুকু তার পেরে ওঠার কথা। তাকে চেনা থেকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, যতদিন ক্রিকেটে আছেন, নিজেকে শতভাগের বেশি উজাড় করেই খেলবেন। কোনো কিছুর আঁচ ক্রিকেটে লাগতে দেবেন না।

অনেকে বলতে পারেন, অবসরের আগে বা পরে, রাজনীতিতে আসতেই হবে কেন? এই জনপ্রিয়তা ধরে রেখে, এই অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে, সবার নায়ক হয়ে থাকতে পারতেন আজীবন! বেশিরভাগেরই দেখি একই কথা, “মাশরাফি রাজনীতিতে না আসলেও পারতো, এত জনপ্রিয় একজন কেন এসব করবেন!”

দয়া করে আমাকে বলবেন, এসবে এই দেশ, সমাজ, তার এলাকার কী লাভ হতো তাতে? এত জনপ্রিয়তা তার দেশে, তার সমাজে, তার এলাকার কোন উপকারে লেগেছে? মাশরাফি নড়াইলের সন্তান বলে কি কেউ সেখানে বাড়তি উন্নয়ন করেছে? তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, নড়াইল কেন তাহলে উন্নয়নের তলানিতে? কেন এত অবহেলিত? কিংবা, এই যে তাকে মুখে আদর্শ মানে এত ছেলেপেলে, কিন্তু এই দেশের, তার এলাকার যুব সমাজ কি সত্যিই বদলেছে? তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে একদিন মাশরাফির জীবন শেষ হবে। তার নড়াইল, এই সমাজ তিমিরেই থেকে যাবে।

বছরের পর বছর ধরে মাশরাফির এত এত কথা যে শুনেছেন, পড়েছেন ইন্টারভিউতে, সমাজ-রাষ্ট্র-দেশ, এসব নিয়ে তার ভাবনা, তার গভীর জীবন বোধ, তার মানবিকতা, তার নেতৃত্ব, এসব পড়ে আপনি ‘বাহ বাহ’ বলে ওঠেননি? তিনি যখন বলেছেন, “ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কোনো জনপ্রিয়তা নয়, ক্রিকেট দিয়ে দেশপ্রেম হয় না, ক্রিকেট দিয়ে একটা রোগীর জীবন বাঁচানো যায় না, ক্রিকেট দিয়ে সমাজের উপকার হয় না”, এসব শুনে ‘বাহ বাহ’ করেননি? আজ কেন তবে ‘ছি: ছি:’! ওসব পড়ে, জেনে আপনি কি বলেননি, ‘এমন ছেলেকেই তো সমাজে দরকার!’ বলেন নি? আমার চারপাশেই অসংখ্য জনকে দেখেছি। সেই ছেলে যখন ‘দরকারে’ লাগতে চান, তাদের অনেকেরই দেখি আপত্তি!

আমরা সবসময় বলি, সচেতন মানুষদের রাজনীতিতে দরকার। অথচ একজন সচেতন মানুষ আসার খবরে আমরা অচেতন হয়ে যাচ্ছি।

ক্রিকেট নায়ক হয়ে থাকা তার জন্য খুব সহজ পথ। বিশ্বকাপ দিয়ে অবসর নেওয়ার পরই অনেকগুলো অপশন তার জন্য রেডি ছিল দলে, বোর্ডে, ক্রিকেটে। টাকা-পয়সাও ভালো, আরামসে জীবন পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু সেভাবে ভাবি আমি-আপনি। মুখ গুঁজে আটপৌরে জীবন কাটিয়ে দেই। সিস্টেমকে গাল দেই। রাজনীতিকে ছ্যা ছ্যা করি। কমফোর্ট জোনের ভেতর নেতিয়ে থাকি।

মাশরাফিরা আবার অন্য ধাতুতে গড়া। আটপৌরে জীবনে তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। কমফোর্ট জোনকে ভেঙেচূড়ে নিজের জোন বানায়। রাজনীতির নোংরা ড্রেন দেখে আমরা নাক সিটকাই, মাশরাফি ড্রেনে নেমে পড়তে চায় পরিষ্কার করতে। মাশরাফি জানে, এই দেশে, এই সমাজে, সিস্টেম বদলাতে হয় সিস্টেমের ভেতর ঢুকে। আপনি-আমি শুধু প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেশ উদ্ধার করি, মাশরাফিরা ক্রিয়ায় ডুবে থাকতে চান।

কোনো কারণে যদি শেষ পর্যন্ত মাশরাফির নির্বাচন না করা হয়, এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুব হতাশ হব...

অনেকে বলছেন, “মাশরাফি কিভাবে এত দিনের ঘুণে ধরা রাজনীতি বদলাবেন? সোহেল তাজের উদাহরণ দেখেননি? এত খারাপের ভিড়ে কিভাবে টিকতে পারবেন? একা কিছুই করতে পারবেন না।”‍ তাদের জন্য বলছি, গোটা দেশ, জাতি, গোটা সমাজ ব্যবস্থা, সবকিছু ভোজভাজির মতো পাল্টে দেওয়া, সব খারাপকে চোখের পলকে শেষ করার মহান দায়িত্ব নিয়ে মাশরাফি রাজনীতিতে আসছেন না। তার প্রাথমিক লক্ষ্য, ভাবনা, স্বপ্ন নড়াইলকে ঘিরে।

নড়াইলকে তিনি মডেল জেলা হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেটা উন্নয়নে, সেবা ও সুযোগ-সুবিধায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠায়, মানবিক বোধে। সেসবের জন্য যা দরকার, সম্ভব সবকিছু করবেন। বাস্তবায়নের পথে যত বাধা আসবে, গুঁড়িয়ে দেবেন। যা গড়া দরকার, গড়বেন। যেখানে নরম হতে হবে বা শক্ত, হবেন। নীতির মধ্যে থেকেই যেখানে আপোষ করা দরকার, করবেন। প্রয়োজনে হবেন কঠোর। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নড়াইলে সেই কর্তৃত্বের নিশ্চয়তা তিনি নেবেন। তার জবাবদিহি থাকবে জনগণের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

নমিনেশন পেপার নেওয়ার দিনই যুবলীগের একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “মাশরাফি আমার সন্তান। ওর দেখভালের দায়িত্ব আমার।” ব্যস, নিশ্চিন্ত! শুরুতে বলেছিলাম না, কেন আওয়ামী লীগ? বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করা মূল কারণ। পাশাপাশি, শেখ হাসিনার ছায়া, শেখ হাসিনার দেওয়া সাহস, বর্ম, অনুপ্রেরণাও আরেকটি বড় কারণ।

যদি ভাবেন, নড়াইলকে তিনি মডেল জেলা করলে অন্যদের কী লাভ? দেশের কী লাভ হবে? লাভ হবে, তার গড়ে দেওয়া উদাহরণ। এই উদাহরণ যে, সদিচ্ছা থাকলে আমার এলাকা, আমার সমাজ বদলে দেওয়া যায়। অন্য নেতাদের, অন্য এমপিদের, অন্য দায়িত্বশীলদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। সেই অনুপ্রেরণা জোগানো। শেখ হাসিনা কিংবা কেউ, একা দেশ বদলাতে পারবেন না। প্রয়োজন এমন অনেক মাশরাফি। এমন একজন মাশরাফিকে দেখে যখন আরও মাশরাফি হবে, অন্তত একজন-দুজন-তিনজন হবে, তবুও লাভ। নড়াইলের মাশরাফিকে দেখে আমার টাঙ্গাইলে একজন মাশরাফি হতে চাইবেন, দিনাজপুরে চাইবেন, বান্দরবানে চাইবেন। আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়বে। ততদিনে এই মাশরাফি না থাকুক, উদাহরণের জন্য আরও কিছু মাশরাফি অন্তত থাকবে। মাশরাফি চিন্তা করেন এভাবেই।

আর মাশরাফি যদি না পারেন? না পারলে নাই। দেশেরে তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। মাশরাফি অন্তত তৃপ্তি পাবেন যে নিজে চেষ্টার কমতি রাখেননি। তার পরও না পারলে সেটা তার সাধ্যের বাইরে বা ভাগ্যে নেই। আবারও বলবেন, ‘তাহলে কেন এখনোর জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকি নেবে?” উত্তরে আবারও বলব, “জনপ্রিয়তা দিয়ে লাভটা কি, যদি সেটা কাজে না লাগে? অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে যদি জনগণের কাজ না করতে পারে, সেটা কেমন নায়ক!”

স্লোগানের কথা বলছিলাম শুরুতে। রাজনৈতিক বা নির্বাচনের স্লোগানগুলো আমাদের কাছে হাস্যরসের উপকরণ। কিন্তু এমন যদি কেউ আসেন, যার ক্ষেত্রে প্রতিটি স্লোগানই দারুণভাবে উপযুক্ত? মাশরাফি আমাদের সেই আনন্দময় বিস্ময় উপহার দিতে পারেন। তাছাড়া, এখনকার চেয়ে অন্তত একজন রাজনীতিবিদকে নিয়ে বেশি গর্ব করতে পারব, এটা কি কম প্রাপ্তি?

অনেকে মাশরাফির জন্য লোক দেখানো হাহুতাশ করছেন, অনেকে মন থেকেই হাহুতাশ করছেন যে, তার তুমুল জনপ্রিয়তায় ধস নামবে। নামতে শুরু করেছে। গালির স্রোত বইছে, যাচ্ছেতাই ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণে বিদ্ধ করা হচ্ছে। মাশরাফি কি এসব জানতেন না? দেশের মানুষের স্বভাব জানেন না? ক্রিকেট কীর্তিতে প্রবল প্রশংসার সময় যিনি বলেন, “আমি তো গালি খাওয়া থেকে স্রেফ দুটি খারাপ ম্যাচ দূরে আছি’, সেই তিনি কি জানেন না তার এই সিদ্ধান্তে কত ঢিল, কত আঘাত সহ্য করতে হবে? জানতেন। জেনেই এই পথে পা বাড়িয়েছেন।

এমন নয় জনপ্রিয়তার ধসকে তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না। মানুষ তো, খারাপ লাগবেই। একজন লোকও তাকে নিয়ে বাজে কথা বললে তার খারাপ লাগে বরাবরই। এখানে তো কোটি কোটি লোকের ব্যাপার। জনপ্রিয়তা, সারা জীবনের অর্জিত সম্মানের মর্ম তিনি বোঝেন। তার পরও, সব জেনে বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগেই বলেছি, নড়াইলের উন্নয়ন, নিজের এলাকা দিয়ে রাজনীতিতে, দেশে একটি উদাহরণ তৈরির তাড়না তার এত তীব্র যে ব্যক্তিগত খ্যাতি, অর্জন সেখানে তুচ্ছ।

যারা ভাবছেন, অর্থের লোভে মাশরাফি এসব করছেন, তাদের বলছি, ক্রিকেটের কমফোর্ট জোনে থেকে, সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে অজস্র অর্থ আয় করতে পারেন অনায়াসেই। ব্র্যান্ড ভ্যালু দিন দিন বাড়ছিল তার, বড়বড় স্পন্সরশিপ তো বটেই, স্রেফ বিভিন্ন শপ বা রেস্টুরেন্ট ওপেন করার জন্যও কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে তার পেছনে ঘোরে অনেকে। টাকার জন্য রাজনীতিতে আসার দরকার ছিল না। যারা ভাবছেন টাকার লোভে এসব করছেন, তাদের জন্য ছোট্ট তথ্য সংযুক্তি, মাশরাফি ব্যাংক থেকে একটি টাকাও ইন্টারেস্ট নেন না কখনও।

যারা বলেই যাচ্ছেন, মাশরাফি একা এই দেশে কিছু করতে পারবেন না, তারা একটু ধৈর্য ধরুন। মাশরাফি জিতলে, দল ক্ষমতায় এলে, তাকিয়ে থাকুন নড়াইলের দিকে। দেখুন, নড়াইলকে সে বদলে দিতে পারে কিনা। তার পর নাহয় প্রশ্ন করবেন! আমি নিশ্চিত, আজ থেকে কয়েক বছর পর আপনি নড়াইলে যাবেন নড়াইল দেখতে। এখন নেতিবাচক কথা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়াবে। মাশরাফিকে উৎসাহ দিতে না পারলে চুপ থাকুন। মাশরাফি ক্রিকেট নিয়ে বাকি জীবন কাটালে দেশ ও সমাজের খুব উপকার হবে না। কিন্তু মাশরাফি এমপি হলে অন্তত একটি জেলা, একটি এলাকার উন্নতি হবে। সেটাও দেশের ক্রিকেটের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বড়।

বাইরে থেকে, বাকি ৬৩ জেলা থেকে যারা নানা তির্যক মন্তব্য করছেন, নড়াইলে যেতে না পারেন, খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা অন্তত করুন। দেখবেন, মাশরাফির নির্বাচন করার খবরে সেখানে কিভাবে উৎসবের জোয়ার বইছে। সাধারণ মানুষ জানে তারা কী পেতে যাচ্ছে। তাদের পালস অনুমান করার চেষ্টা করুন। প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেওয়ার জন্য সারা দেশেই জরিপ চালিয়েছেন, এটা খবরে এসেছে। নড়াইলে মাশরাফিকে কেন বেছে নিয়েছেন তিনি, সেটা বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। নড়াইলের মানুষ তাকে চায় প্রবলভাবে। সেটাও বোঝার চেষ্টা করুন।

আর এসব কিছু না পারুন, নিজের কাছে একটি প্রশ্ন করুন। আপনার এলাকায় মাশরাফি নির্বাচন করলে আপনি কি তাকে ভোট দেবেন না?

যে উত্তর পাবেন, সেখানেই মিশে থাকবে আপনার চাওয়া, ভাবনা, মানসিকতা। বাংলাদেশের মাশরাফি, আওয়ামী লীগের মাশরাফি, নড়াইলের মাশরাফি নিজের কাছে পরিষ্কার। আপনি-আমি নিজের কাছে পরিষ্কার হই...!
আরিফুল ইসলাম রনি: সাংবাদিক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.