Sylhet Today 24 PRINT

আমার শরীর ঢেকে রাখলে ধর্ষণ কমে যাবে?

মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি |  ১৬ মে, ২০১৯

‘উত্তর দেন কেন?', শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রায়ই আমাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করেন, জবাব দিতে মানা করেন। কিন্তু আমার তো মনে হয় জনে জনে ধরে আমি আমার কথা বলি, উত্তর দেই, আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জানান দেই। কিন্তু আমি থমকে দাঁড়াই একটা প্রশ্ন নিয়ে, আমি আসলে কাকে বোঝাতে যাচ্ছি বা চাচ্ছি? কারা ওরা? তাদের কি প্রভাব আছে আমার জীবনে? এসব প্রশ্ন খোঁজার আগেই আমি ফিরে তাকাই আমার নিজের পায়ের মাটির নীচে, কোথা থেকে আমার উত্থান, কোথায় আমার জন্ম, আমার পরিবার? এই পরিবারের কথা যখন মাথায় আসলো, তখন অংক কষি, এই পরিবারের সদস্যদেরইতো সবাইকে এক ছাতার নীচে আনা যায়না, তাহলে আমি এই সমাজের/ পৃথিবীর মানুষদের আর কি জানাতে/ বোঝাতে যাবো?

রেখে দেই ঐ আহাজারি, আচ্ছা, বলুন তো, কখনো কি আপনি/ আপনারা আমার পথে হেঁটেছেন? আমার জুতাগুলো পরেছেন? আপনার ঘাড়ে আমার ভারী মাথাটা রেখে দেখেছেন? সেই মাথাটা আমার বালিশে গিয়ে রেখেছেন? আমার হয়ে ঘুমিয়েছেন, দুঃস্বপ্নতে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়েছেন বা বোবা কান্নায় ভেসেছেন? আমার কোন যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন বা হারানোর ব্যথায় দিশেহারা হয়েছেন? আচ্ছা ঐসব কথা বাদ দিন বাস্তবতায় আসি, আমার বাসার কোন বিল দিতে এসেছেন বা কোন বাজার? আচ্ছা, সবচেয়ে সোজা কাজ বলি, আমার বাচ্চার চুল কাটাতে নিয়ে গিয়েছেন? বা আমার বাসার ময়লার ব্যাগটা ফেলতে গিয়েছেন? অথবা, রাত তিনটায় উঠে বাচ্চার বমি পরিষ্কার করেছেন, হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন? এমন হাজারো কাজের লিস্ট আমি দিতে পারবো যা আপনাদের মধ্যে কেউ এসে করতে পারবেন না, ঠিক তেমনি আমিও পারবো না আপনাদের জীবন আমি যাপন করতে বা বইতে।

এখন কথা হচ্ছে, আমরা যেহেতু কেউ কারোর জীবন যাপন করতে পারিনা তাহলে কেন, আমি যখন কোন ছবি বা কোন লেখা পোস্ট দেই, তখন এক শ্রেণীর মানুষ কেন আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েন , আপনাদের ইচ্ছা , মতাদর্শ , বিশ্বাস আমার উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য?

ভণিতা না করে একটু সরাসরি-ই বলি, যেকোনো পোস্ট বা ছবিতে কমেন্টের বাহার যদি আমি দেখি, তাহলে বেশীর ভাগ মন্তব্যগুলো শুধুমাত্র একটি ধর্ম কেন্দ্রিক , আর সেই অনুযায়ী মন্তব্যগুলো এমন যে , ‘ধর্মে নারীদের এইটা পড়তে নিষেধ করছে, নারীদের এই ভাবে চলতে নিষেধ করছে, নারীদের এইভাবে কথা বলতে নিষেধ করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ একজনও বিন্দু মাত্র ইঙ্গিত করেনা, নরদের কিভাবে চলতে বলা হয়েছে, কি তাদের বিধিনিষেধ।

আরে ভাই, আমি কি জীবনে কোথাও উল্লেখ করে বলেছি যে, কোন ধর্ম ভালো না, ধর্মের বিধিনিষেধগুলোকে কি আমি অগ্রায্য করছি, কাউকে অনুসরণ করতে মানা করেছি বা কোন ধর্মের বিরুদ্ধে কাউকে উস্কে দিচ্ছি বা প্রভাবিত করছি ? কেউ কি দেখাতে পারবেন ? আপনি আপনার ধর্ম পালন করুন, বিশ্বাস শক্ত রাখুন, চর্চা করুন, মানা করছে কে?? আমি অন্তত জোড় গলায় বলতে পারি , আমি কারো কোন রকম ধর্ম চর্চায় না-সুচক / নেতিবাচক কোন শব্দ আমার মুখ থেকে বের হয়নি। কিন্তু আপনি/ আপনারা কে যে, আরেকজনের উপর আপনার ব্যাক্তিগত মতামত, বিশ্বাস, রুচি, মান, রীতিনীতি, ধরন , জীবনভঙ্গি, চালচরন- ঢং চাপিয়ে দিবেন এবং আপনার পছন্দসই তা না মানলেই সেই ব্যাক্তি পৃথিবীর নিকৃষ্ট জাতির প্রাণী !!

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই এই দেখে যে, সব মহান ধর্মের অনুসারীরা মেয়েদের প্রোফাইলে প্রোফাইলে থাকেন আর গালি গালাজ করে করে ধর্ম প্রচার করেন? বাহ বাহ!! গালিগালাজ করা আপনার পবিত্র ধর্মের গ্রন্থে লেখা আছে, তাই না? ধরে নিলাম, আপনার ধর্ম একমাত্র ভালো, আর পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম সব খারাপ। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনার ধর্মের গ্রন্থে কোন জায়গায় লেখা আছে যে, ‘তোমার বিশ্বাস আর ইচ্ছার অনুসারী কেউ না হলে তারে সমানে গালিগালাজ দেয়া শুরু করো, অনলাইনে মন্তব্যে বয়ান চাপিয়ে দেয়ার জোরপূর্বক চেষ্টা করো, গুষ্টিকিলাও, সে কি কাজ করছে, তার পেশা কি, সে কিভাবে তার জীবন চালাচ্ছে, প্রয়োজনে হেয়-প্রতিপন্ন করে তার কাজ কিভাবে বন্ধ করা যায় সেটার জন্য একত্র হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করো, সমাজ ত্যাগ করাও- দেশ ত্যাগ পারলে করাও। আর হ্যাঁ, তোমার ধর্মের ব্যাতিত অন্য ধর্মের সকল নারীদের/ মডেলদের/ সেলিব্রিটিদের জন্য ওয়াহ ওয়াহ করবা আর মুখের লোল ফেলবা, কারণ তোমাদের জন্য এর চেয়ে সুন্দর হুরপরী অপেক্ষা করছে।’’

আচ্ছা কিছু প্রশ্ন ছিলো,
আমি শরীর ঢেকে রাখলে ধর্ষণ কমে যাবে, নাকি বাংলাদেশের সব মডেল-সেলিব্রিটিদের শরীর ঢাকলে ধর্ষণ কমবে? আচ্ছা ধরুন আমরা সবাই মিলে শরীর ঢাকা শুরু করলাম, তখন আপনার ক্যাটরিনা-কারিনা- সানি লিওনির কি হবে, ওদের শরীর দেখে ধর্ষণ করতে ইচ্ছা হবে না তো? নাকি ওদের ও পর্দা করতে বলবেন? আচ্ছা ধরুন ওরাও পর্দা করা শুরু করলো, তখন হলিউডের নারী স্টারদের কি বলবেন, পর্দা করতে? তখন আপনারা বিনদিতো হবেন কি করে, হামদ আর নাত শুনে? যদি হামদ-নাত এ আপনাদের বিনোদন হয় তাহলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনারা কি করেন? নাকি বলবেন, মুসলিম হোক আর অমুসলিম সব নারীদের পর্দা করে চলতে হবে, আর আমরা অণ্ডকোষ বের করে হাঁটবো ?

শেষ করি, নিজ জীবনের ছোট্ট অংশ নিয়ে। আমি আর আমার দুই বাচ্চা সহ যখন আমি রাস্তায়, ভাগ্য বা খারাপ সময় যেটাই বলিনা কেনো, যখন মাথার উপর থেকে ছাদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়, ভিন দেশে বাচ্চাদের কি খাওয়াবো , কি পড়াবো, সেই মা তখন অসহায়, ভয়ে-আতঙ্কে জর্জরিত। তখনই এই খ্রিস্টান দেশ অর্থাৎ আপনাদের ভাষায় কাফেরদের দাতব্য সংস্থা এসে সেই মা-এর দুধের বাচ্চাদের কনকনে শীতের রাতে ছাদ এর বন্দোবস্ত করেন, সাথে অন্ন এবং বস্রের। একবারের জন্য জিজ্ঞেস করেনি কেউ, আমি কোন ধর্মের বিশ্বাসী, অনুসারী। বিচার করতে আসেনি আমাদের।

এখন নিশ্চই বলবেন না, উপরওয়ালা ফেরেশতা পাঠিয়েছেন, তাহলে আপনার নিকট প্রশ্ন থাকবে, উপরওয়ালা কাফেরদের নিকটেই ফেরেশতা কেন পাঠিয়েছেন?

এই কাফিরদের দেশে থেকেই কাজ করে বা ঐ দেশের সরকারী ফান্ড থেকে খেয়ে বসে পড়ে নিজ পরিবার সামলাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, চলে বহু মসজিদ -মাদ্রাসা, অস্বীকার করতে পারবেন? আপনাদের মাঝে ৯৫% মানুষও ঐ কাফেরদের শহরেই সুযোগ পেলে চলে আসতে চাইবেন সুন্দর জীবনের আশায়, অস্বীকার করতে পারবেন? আচ্ছা মধ্যে -প্রাচ্যে কেউ গিয়ে ইউরোপ -আমেরিকার মতো Asylum Seek করতে পারে ? বিষয়টি আমার জানা নেই, আপনাদের জানা থাকলে জানাবেন। ওহ, আপনারা জানবেন কিভাবে, আপনারা তো ব্যস্ত আমি/ আমরা কি পোশাক পড়েছি, শরীর ঢাকা আছে কি নেই। শরীর দেখাই আমি আয়ারল্যান্ডে কিন্তু ধর্ষণ এর পরিমাণ নাকি তার জন্য বাড়ে বাংলাদেশে। What a logic!!

চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ডের কল্পনা করুন তো, টিভি তে নাটক হচ্ছে বা বিজ্ঞাপন চলেছে, সিনেমা হলে মুভি চলছে, সব নারী কালো রঙের বোরখা পরা, শুধু চোখ দেখা যায়। সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে গিয়েছেন কিংবা শপিং সেন্টারে , রাস্তা-ঘাটে ঘরে-বাইরে সবাই কালো বোরখা পরা, কি সুন্দর পৃথিবী তাইনা!!

চলুন আমরা আবার গালি দেয়া শুরু করি … মাগী, ব্যাশ্যা , শরীর বিক্রেতা কারী …
আর খদ্দেরগন যেনো কারা??

(ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তী: লেখক, মডেল।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.