Sylhet Today 24 PRINT

একাডেমিকের বিরুদ্ধে তদন্ত জনস্বার্থের অনুকূলে নয়

আলী রীয়াজ |  ২৩ মার্চ, ২০২০

বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষকের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সংবাদ উদ্বেগজনক এবং এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো যে কোনও একাডেমিকের দায়িত্ব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের মলয় কে মৃধার বিরুদ্ধে তদন্তের সূচনা করেছে বাংলাদেশে কভিড-১৯ (করোনাভাইরাসের) সম্ভাব্য বিস্তার বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন রচনার পরে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকদের উদ্ভাবিত একটি মডেলের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি যৌথভাবে লিখেছেন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ গবেষক: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের মলয় কে মৃধা ও রিনা রানি পাল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের দীপক কে মিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের অ্যালাইন ল্যাবরিক ও ইফ্যান ঝু।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ না নিলে, কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরে বলেছে যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে কভিড -১৯ বিষয়ে কোনও ধরণের গবেষণা চালায়নি, কমিশন করেনি বা প্রকাশ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা বিষয়ক কোনও নীতিমালা ভঙ্গ করা হয়েছে কিনা তারা তা তদন্ত করছেন এবং ভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে “ডিসিপ্লিনারি এ্যাকশন” নেয়া হবে।

গবেষকদের ঐ প্রতিবেদনটি আমি পড়েছি তাতে কোথাও গবেষকরা বলেননি যে তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেন বা কোনও বিশ্ববিদ্যালয় এই গবেষণা কমিশন করেছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিবেদন হচ্ছে প্রখ্যাত এপিডেমিওলোজিস্ট নিল ফার্গুসনের নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত ওই মডেলের ব্যবহার এবং বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদনে ঐ সব তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে যা পাবলিকলি পাওয়া যাচ্ছে, সরকারের দেয়া। ফলে এই জন্যে কেন একজন গবেষককে আলাদা করে অনুমতি নিতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। মৌলিক গবেষণার জন্যে আইআরবি’র যে প্রয়োজন থাকে তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবার কথা নয়। তদুপরি কভিড-১৯ বিষয়ে এই ধরণের প্রজেকশন বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রেই করা হয়েছে।

নিল ফার্গুসনের ঐ মডেল অনুযায়ী যুক্তরাজ্যেও প্রায় ৫ লাখ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২২ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যেতে পারে। এ ছাড়া এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হংকংয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মেডিসিনের চেয়ারম্যান প্রফেসর গ্যাব্রিয়েল লিউং বলেছিলেন করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এতে বিশ্বে মারা যেতে পারেন সাড়ে চার কোটি মানুষ। আক্রান্ত হতে পারেন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ। মডেলিংয়ের ভিত্তিতে প্রজেকশন হচ্ছে গবেষণা ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতি।
ভারতের সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইনামিকস, ইকনোমিকস এ্যান্ড পলিসি’র পরিচালক রামানান লাক্সমিনারায়ণ বিবিসি’র সঙ্গে ১৯ মার্চ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই মডেলিংয়ের ভিত্তিতে ভারতে ৩০০ মিলিয়ন (তিরিশ কোটি) আক্রান্ত হতে পারে (দেখুন বিবিসির ভিডিও ১৯ মার্চ; ইন্ডিয়া টুডে’র রিপোর্ট ২১ মার্চ)।

এই বিষয়ে বেস্ট কেস সিনারীও তিনি বলছেন ২০ কোটি। যে সব প্রজেকশন করা হয়েছে সেগুলো সবটাই যে ১০০ ভাগ সঠিক হবে তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই ধরণের প্রজেকশনের কারণ হচ্ছে নীতি নির্ধারকদের জানানো যে অবস্থা কতটা বিপদজনক ও ভয়াবহ হতে পারে। এই ধরণের প্রজেকশনের জন্যে কেন একজন গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের রোষানলে পড়বেন সেটাই উদ্বেগের বিষয়।

বিশ্ব যে মহামারির মোকাবেলা করছে তা গত একশো বছরে ঘটেনি। সেই রকম সময়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষককে প্রচলিত নিয়ম কানুনের অজুহাত দেখিয়ে তিরস্কার করা কেবল যে এই বিষয়ে আলাপ আলোচনার পথেই বাধা তা নয় – যে কোনও ধরণের একাডেমিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এই ধরণের চাপ সরকারিভাবে যা বলা হচ্ছে তার বাইরে কোনও ধরণের আলোচনাকে রুদ্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ বলেই প্রতীয়মান।

কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার ওপরে ‘অদৃশ্য চাপ’ আছে কিনা তা বের করার দায়িত্ব গণমাধ্যমের; একাডেমিকদের কাজ হচ্ছে এখন এর প্রতিবাদ করা, সংশ্লিষ্ট সকলকে মনে করিয়ে দেয়া এই ধরণের পদক্ষেপ জনস্বার্থের অনুকূলে নয়।

  • আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।

লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.