Sylhet Today 24 PRINT

উদ্যোক্তাদের ধর্মপরিচয়ে ফিরে আসে সাতচল্লিশের গ্রাম

মাসকাওয়াথ আহসান |  ০৫ মে, ২০২০

বিদ্যানন্দ নামের একটি কল্যাণমূলক সংস্থা যখন ব্যতিক্রমী কাজ করে সবার মন জয় করে চলেছে; তখন এর প্রাণপুরুষ কিশোর কুমার এই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে গেলেন।

বিদ্যানন্দের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেলো, "বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০ ভাগ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই চালিয়ে যান বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। সে সমস্যাও আশা করি সমাধান হয়ে যাবে। বিদ্যানন্দ প্রধান গত মাসেই পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।"

বিজ্ঞাপন

"উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়" বাক্যবন্ধটি শুনে মনে হবে; আমরা যেন ফিরে গিয়েছি ১৯৪৭-এর গ্রামে। এই গ্রাম ভুগিয়েছে অনেক। হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ক্ষত আজ ভেতরে ভেতরে যে ক্যানসারে পরিণত হয়েছে; তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

বিদ্যানন্দ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে কিশোর কুমার আর তার বিদ্যা ও কল্যাণমুখী কাজের অনেক প্রশংসা মিডিয়ায় এসে পড়ার পর; কিছু সংখ্যক কুঁচকুঁচানি মুসলমান গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুর শুরু করলো, "বিদ্যানন্দ নামডা হিন্দু-হিন্দু শোনায়।" আর এক দল বিভাজনবিদ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে, উদ্যোক্তার ধর্মপরিচয় নিয়ে আশংকা প্রকাশ শুরু করলো।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালো কাজের প্রশংসা অসংখ্য মানুষ করেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দল নির্বিশেষে মানুষের ভালো কাজের প্রশংসা মানুষ করে।

বিদ্যানন্দ সংগঠনটি এতো প্রশংসার মাঝে; কেন উদ্যোক্তার "ধর্ম-পরিচয়" নিয়ে সমালোচনাকে এতো গুরুত্ব দিলো; তা বোধগম্য নয়। বিভিন্ন সংগঠনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা আশংকা করি, সাধারণত সংগঠন দখলের ক্ষেত্রে এমন খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করানো হয়। উদ্যোক্তা কিশোর কুমার বিদ্যানন্দের প্রধানের পদ থেকে "সরে যাওয়া" বা তাকে "সরিয়ে দেবার" বিষয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

সংগঠন একটি সামষ্টিক কাজ হলেও উদ্যোক্তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ছাড়া তা সফল হয় না। সনজীদা খাতুন ছাড়া "ছায়ানট" হয়না, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছাড়া "বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র" হয় না; সুতরাং কিশোর কুমার ছাড়া "বিদ্যানন্দ" হয় না।

ধরা যাক গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা খুব ভালো ফল করছে। তখন ঐ স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। গ্রামের মানুষ স্কুলের উদ্যোক্তা প্রধান শিক্ষককে "প্রমিথিউস"-এর সম্মান দেয়; যিনি এক টুকরো আলোর আগুন এনে গ্রামকে আলোকিত করছেন।

এই স্কুলের ভালোটা আবার সহ্য হয়না কিছু মানুষের। তারা ক্ষিপ্ত হয়, হেড মাস্টারের এতো সুনাম হইবো কা; আমরা কী উইড়া আইছি। হেডমাস্টার অত্যন্ত সৎ হওয়ায়; বিদ্যানন্দ স্কুল থেকে টেকাটুকানন্দ পাওয়া খুব কঠিন। সুতরাং তাকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হবে। কাসিম বাজার কুটিরে বসে শলা-পরামর্শ করবে ঈর্ষা-পাগল লোকেরা।

হেডমাস্টার "হিন্দু" হলে তো কথাই নেই। ধর্মীয় অনুভূতির কম্পনে তাকে সরে যাবার পরিবেশ তৈরি করা হয়। আর হেড মাস্টার মুসলমান হলে, সে জামায়াত-বিএনপির কারো ফুফার ভাগ্নের নাতি বলে আওয়ামী লীগ অনুভূতির শীৎকারে তাকে সরিয়ে দেয়া হবে। সরানো তাকে হবেই তা ধর্মীয় অনুভূতির জজবা হোক কিংবা রাজনৈতিক অনুভূতির ফন্দি-ফিকির তুলেই হোক। আসল ব্যাপার হচ্ছে হেড মাস্টার সৎ ও যোগ্য। সে থাকলে টেকাটুকানন্দ লাভের কোন উপায়ই নেই।

এখন ২০২০ সালে ঢাকা মহানগরীর একটি সংগঠন বিদ্যানন্দের উদ্যোক্তা কিশোর কুমারকে সরে যাবার পরিবেশ তৈরির মাঝ দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে যায়; এটা সেই বিজন গ্রাম যেখানে ৪৭ সালে হিন্দু বলে অনেক স্কুল শিক্ষক ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো।

এই ধর্মীয় বিভাজনের পাপে পুড়ে পাকিস্তান ছাই হয়ে গেছে; ভারত প্রায় সত্তর বছর এই ধর্মীয় বিভাজনের সাপকে ঝাঁপিতে আটকে রাখার চেষ্টা করে অবশেষে ব্যর্থ হয়েছে। সাপ ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে দংশন করে চলেছে। ইসলামি কট্টর পন্থা আর কট্টর হিন্দুত্ববাদের বিষ দক্ষিণ এশিয়াকে মৃত প্রায় করে রেখেছে।

আমরা আশা করেছিলাম, এই বিভাজনের রাহুকালে বাংলাদেশের মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রীতির আলো জ্বেলে রাখবে। কঠোর পরিশ্রমের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুধা-দৈন্য মুক্তি ঘটেছে। সুতরাং অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের ক্ষুধা; আর মনের মধ্যে বিভাজনের দৈন্য কমে আসবে; এটুকু খুব বেশি আশা নয়।

করোনা এসে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো, তার চোখে হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরীব, আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিবেচ্য নয়। সে মানুষের শত্রু। করোনা-রাক্ষসের বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত হবার সূত্র ধরে; এটা আমাদের শেষ সুযোগ ধর্মীয় বিদ্বেষ-বিভাজনের অভিশাপ মুক্ত হয়ে সভ্য জীবন যাপনের। যদি বাঁচি মানুষ আর নিসর্গকে ভালোবেসে মানুষ হিসেবে বাঁচবো-এটা করোনার শিক্ষা।

নাগরিক সমাজের উদ্যোগী হওয়া উচিত কিশোর কুমারকে বিদ্যানন্দের দায়িত্বে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে। কিশোর কুমার ছাড়া এই সংগঠন বিদ্যানন্দ থাকবে না; টেকাটুকানন্দ হয়ে উঠে অবশেষে বন্ধ কিংবা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.