Sylhet Today 24 PRINT

কমরেড আসাদ্দর আলী, মৃত্যু নেই যাঁর

এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম |  ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

স্কেচ: কুমার অনিক কুন্ডু

আমার রাজনীতি জীবনের সূচনাপর্বে কয়েকজন রাজনীতিবিদের সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁদের অন্যতম জননেতা কমরেড আসাদ্দর আলী। সে অর্থে তিনি আমার রাজনৈতিক শিক্ষকদের অন্যতম একজন। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস বিবর্তনের তথ্য এবং তত্ত্ব দু’য়ের সমন্বিত জ্ঞান ছিল তাঁর। সিলেট শহরের ধোপাদিঘীর পূর্বপারস্থ তাঁর বাসভবনে প্রতিদিনই আমরা ছুটে যেতাম, জড়ো হতাম সামনের চৌচালা ঘরে। অনেকেই আসতেন সেখানে, আবার চলেও যেতেন। কিন্তু আমরা যেতাম না, বসে থাকতাম। মনে হতো আমরাই উনার খাস লোক।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজনৈতিক আলোচনা চলতো, প্রতিদিন নতুন প্রসঙ্গ। কখন ইসকান্দার মির্জা পাকিস্তানি রাজনীতিতে প্রথম সামরিক আইন জারি করেছিলেন, কিভাবে আইয়ুব খান ইসকান্দার মির্জাকে উৎখাত করে বিদেশে পাঠালেন, সাম্যবাদী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ভারতীয় রাজনীতির কোন প্রেক্ষাপটে গান্ধীকে জাতীয় নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন....... ইত্যাকার নানা বিষয়, বহু প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলেছেন তিনি অবিরত। মনে হতো ইতিহাস চর্চার কি শেষ নেই। আসলেই চলমান ঐ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার এ মহান নেতার সর্বশেষ নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে। তাঁর মৃত্যুর ০২/০৩ দিন পূর্বেও আত্মগোপনকারী বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা কমরেড দ্বিজেন সোম তাঁকে কাজীটুলা উঁচা সড়কস্থ অস্থায়ী ভাড়াবাসায় দেখতে গেলে শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরে লাল সালাম জানিয়েছিলেন ফেলে আসা জীবনের এ সহযোদ্ধাকে।

জননেতা আসাদ্দর আলী ছিলেন নানামুখী প্রতিভার সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। সুদর্শন এই লোকটি কখনো নিজ গুণাবলীর প্রতি মোটেই যত্নবান ছিলেন না। যার ফলে তাঁর মধ্যে নিহিত কোন নির্দিষ্ট একটি চরিত্র বিশেষত্ব হয়ে প্রকাশ পেল না, তিনি রয়ে গেলেন মিশ্রিত এক বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের বাহক হিসেবে। যদিও রাজনীতিবিদই হচ্ছে তাঁর মুখ্য পরিচয়। সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্ম সমূহের ঘনিষ্ঠজনদের অনেককেই শুনেছি তাঁকে “কবি সাহেব” বলে সম্বোধন করতে। এদের একজন হচ্ছেন প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে যথাক্রমে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ও বিএনপি রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট গুলজার আহমদ। কমরেড আসাদ্দর আলী একজন অসাধারণ কাব্যগুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট কবিতা- প্রবন্ধে শ্রেণি চেতনাবোধ প্রকাশ পেত সূচের মতো, যদিও সেগুলোকে কখনোই রাজনৈতিক স্লোগান বা লিফলেট বলে মনে হতো না। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ দেশে সামরিক শাসন জারি করে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে বঙ্গভবন থেকে বের করে দিলে আমরা অনেকেই সমবেত হই তাঁর ধোপাদিঘীরপারস্থ বাসভবনে।

সেদিন তিনি আমাদেরকে নিয়ে বাহিরে চৌচালা ঘরে না বসে ভিতরের ঘরেই বসলেন এবং স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিছানায় কাত হয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় আমাদের সাথে আলাপ করতে লাগলেন। মুহূর্তর মধ্যে ফেলে আসা পাকিস্তানি রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের মর্মকথা অতি সংক্ষেপে বিবৃত করলেন। কিভাবে পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে আমলা গোলাম মোহাম্মদের অগণতান্ত্রিক শাসন জারি করা হয়েছিল, কিভাবে গণপরিষদের সভাপতি তমিজ উদ্দিন খানের দায়েরকৃত সিন্ধু হাইকোর্টের মামলা পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি রাজনীতিতে অসাংবিধানিক ধারা অনুপ্রবেশ করলো। সবই তিনি বলে ফেললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসন হলেও এর ধারাবাহিকতা সেই পাকিস্তানি রাজনীতির ২৫ বছর থেকে হিসেব কষতে হবে এবং এও ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে, আসলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রকৃতঅর্থে স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান নামের একটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের আরেকটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি এবং ক্ষমতায় দলের পরিবর্তন হলেও শাসক শ্রেণির উৎখাত হয়নি। যার কারণে পুরাতন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে বাকশাল নামক একদল গঠন করে অপরাপর দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সহ রক্ষীবাহিনী গঠন ও ঐ বিশেষ বাহিনীর উপর নির্ভর করে দেশ শাসনকেও সামরিক শাসনের সাথে তুলনা করলেন। সবকিছুর মধ্যে তিনি আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’আমলে রাষ্ট্রীয় ফরমান জারির মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক চর্চাকে কখনো বন্ধ করা যায়নি, বন্ধ হয়নি। এদেশের প্রগতিশীলরা প্রতিকূল পরিবেশে সদা সর্বদা অতীব ঝুঁকি’র মধ্যেও তৎপর থেকেছেন। প্রয়োজনে কৌশলে, কখনো গোপনে অথবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে রাজনীতিকে সচল রাখতে হবে এবং এটা হচ্ছে বাম রাজনৈতিক কর্মীদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

কমরেড আসাদ্দর আলীর সেদিনের তাৎক্ষণিক বক্তব্য সমবেতদেরকে উজ্জীবিত করে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল এবং সামরিক আইনে ভীত না হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমরা সেদিন তাঁর কথায় বাঙলাদেশ লেখক শিবির এর মাধ্যমে কর্মকাণ্ড যৌথভাবে চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং যতদিন রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল ততদিন প্রধানত লেখক শিবিরের ব্যানারে সক্রিয় ছিলাম। তখন লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ড. আহমদ শরীফ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহরিয়ার কবির। একবার মহান মে দিবস উপলক্ষে লেখক শিবিরের প্রকাশনায় একটি লেখা দেয়ার জন্যে কমরেড আসাদ্দর আলীকে অনুরোধ করলে তিনি অনুপম একটি কবিতা লিখে দেন। যার নাম ছিল “লাল পতাকার জন্মদিনে”। মৃত্যু শয্যায় থেকে এক পর্যায়ে তিনি তাঁর নিজ কবরের এপিটাফ রচনা করে যান, সেটি হচ্ছে, “জীবনের তরে লড়ে যারা মরে, মৃত্যু নাই তাঁর”। কমরেড আসাদ্দর আলীর লেখক সত্ত্বা নিয়ে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সামরিক শাসন আমলেই ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা “ফাগুন” নামে একটি পত্রিকা বের করি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলাম আমি নিজে। সেখানে আসাদ্দর ভাই সিলেটে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি বিরল মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় গ্রন্থ সমালোচনা কলামে ঐ স্মরণিকার আলোচনা করতে গিয়ে প্রবন্ধটির বহুবিধ প্রশংসা করেছিলেন অনেকে। যেখানে লুপ্ত গোবিন্দ চরণ পার্কে ভাষা আন্দোলনকারীদের সমাবেশে মুসলিম লীগ গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণের চাক্ষুষ বর্ণনাসহ হযরত শাহজালাল (র.) দরগাহ শরীফের তৎকালীন মতোয়াল্লী এজেড আব্দুল্লাহ’র ভাষা আন্দোলনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি বিবিধ বিষয় জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি।

আমার কাছ থেকে ফাগুন পত্রিকার সংরক্ষিত সংখ্যাটি সাম্যবাদী দলের নেতা শ্রদ্ধেয় ধীরেন সিংহ নিয়ে যাওয়ায় এবং সেটি তিনি আর খোঁজে না পাওয়ায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসময় প্রবন্ধটি চিরতরে হারিয়ে গেল। সিলেটে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালে আন্দোলনের দু’পর্যায়ে যে কয়েকজন ভাষাসংগ্রামী অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রবর্তী। চলার পথে অনেক বামপন্থী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়েছে আমার, এদের মধ্যে কমরেড আব্দুল হক, অজয় ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, হাজী দানেশ, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের অনেককেই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করতে দেখেছি। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকাংশের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল অগ্নিযুগের সংগঠন যুগান্তর এবং অনুশীলন এর ভিতর দিয়ে। যুগান্তর এবং অনুশীলন সংগঠনের কঠিন সংযম, অধ্যবসায় এর সাথে ভারতীয় সমাজের আদি বিষয়াদির চর্চা হতো। হোমিওপ্যাথি উপমহাদেশের আদিভিত্তিক না হলেও যুগান্তর-অনুশীলন সংগঠনে এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। সেই ধারায় কমরেড আসাদ্দর আলীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ঘরে সব সময়ই কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধ থাকতো এবং লোকজনকে, বিশেষ করে গরীব রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা ও মেহনতি মানুষকে তিনি বিনা পয়সায় হোমিও চিকিৎসা প্রদান করতেন। অনেককেই তাঁর কাছ থেকে হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেখেছি, আমি নিজেও দু’একবার কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছ থেকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গ্রহণ করেছিলাম। সাংবাদিকতা, প্রেস ও প্রিন্টিং এর সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। শুনেছি একসময় সিলেট প্রিন্টার্স সিলেট শহরের নাইওরপুলে অবস্থিত ছিল এবং ঐ প্রিন্টার্স-কে কেন্দ্র করে পত্রিকা প্রকাশ ও প্রিন্টিং কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শ্রদ্ধেয় আসাদ্দর আলী । জীবনের শেষাংশে তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করেন এবং সাম্যবাদী দলের মুখপত্র গণশক্তি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকাটি যাতে নিয়মিত বের হয় সেলক্ষ্যে কোন কোন সময় প্রেস কর্মচারীদের সাথে নিজেও কম্পোজিং এর কাজে নিয়োজিত হতে দ্বিধান্বিত হতেন না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রিন্টিং এর কম্পোজিং তাঁর জানা ছিল।

আজীবন সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে জেল, হুলিয়া সহ ব্যস্ত থাকা এই লোকটি নিজ জন্মস্থান ও স্থানীয় সমাজসেবা নিয়েও ভাবতেন। ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বালাগঞ্জ থানাধীন তাজপুর, কাজীরগাঁওয়ে তাঁর জন্ম। পিতা মরম আলী ও মাতা জুলেখা খানমের ৪ সন্তানের মধ্যে তিনি হলেন তৃতীয়। বালাগঞ্জ থানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তাজপুর মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং এর উন্নয়নে অর্থ সংগ্রহের জন্যে তিনি বিলেত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যায় দেশের অপরাপর অংশের সাথে সিলেটও উপদ্রুত হলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে গঠিত কমিটির পরিচালনায় সিলেট স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল চ্যারিটি ফুটবল খেলার।

জননেতা আসাদ্দর আলীর চরিত্রের মধ্যে নানা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাঁর প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন আগাগোড়া রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাজপুর পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা ও মঙ্গলচণ্ডী নিশিকান্ত উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিকুলেশন পাশ করে সিলেট শহরে মদনমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন এবং একই প্রতিষ্ঠানে বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫১ সালে ফরেস্টার পদে যোগদান করলেও কয়েক মাসের মধ্যেই চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে সার্বক্ষণিক রাজনীতি চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলাভের অব্যবহিত পূর্বে সিলেটে ছাত্র ইউনিয়ন নামের সংগঠন গড়ে তুলতে পুলিশি বাঁধার মুখেও যাঁরা অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আসাদ্দর আলী। ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মধ্যে অন্যান্য যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ খান, ওয়ারিছ আলী ও মওলানা শামসুল হক প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের পর দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন পর্যায়ক্রমে। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মহান নেতা কমরেড স্ট্যালিন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কংগ্রেসে সোভিয়েত পার্টি ‘শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব’ বলে বক্তব্য নিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে আদর্শিক বিতর্কের ঝড় উঠে। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অপরদিকে চীন ও আলবেনিয়ার লেবার পার্টি। চীন-রাশিয়ার বিতর্কে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাম শিবিরও বিভক্ত হয়ে পড়ে।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) দু’ভাগে ভাগ হয়ে ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (ওয়ালী) গঠিত হয়। কমরেড আসাদ্দর আলী চীনের বক্তব্যকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করে ন্যাপ (ভাসানী) তে অবস্থান নেন। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির চীনপন্থি বলে পরিচিত অংশ গোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) গঠন করেন এবং কমরেড আসাদ্দর আলী (এমএল) এর নেতৃত্বদানকারী কমরেড আব্দুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহা’র সাথে একাত্ম থাকেন। ভারতের পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি থানায় কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সংঘটিত ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থানের প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এর সদস্যরা গণসংগঠনের রাজনীতি ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের পরেও কমরেড আসাদ্দর আলী কে ন্যাপ (ভাসানী) এর প্রকাশ্য রাজনীতিতে তৎপর থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। জাগমুই গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীরা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, এনায়েৎ উল্লাহ খান, অ্যাডভোকেট খোন্দকার আব্দুল ওদুদ, সিরাজুল হোসেন খান এবং আসাদ্দর আলী। প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসাদ্দর আলী ন্যাপ (ভাসানী) ও জাগমুই এর মধ্যে তৎপর থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল ) থেকে বের হয়ে এসে মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) এর সাথে যুক্ত থাকেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী গঠিত হলে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো, বিশেষ করে চীনপন্থি নামে পরিচিত গোপন দল গুলোর উপর নেমে আসে চরম অবর্ণনীয় বর্বর নির্যাতন। সাম্যবাদী দল পরিণত হয় সরকারের টার্গেটে। রাজশাহীর তানোর নামক স্থানে একই দিনে হত্যা করা হয় সাম্যবাদী দলের ১১ জন বিপ্লবীকে। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাক ও তৎপরবর্তীতে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটলে এক পর্যায়ে সাম্যবাদী দল (এমএল ) গোপন অবস্থান পরিত্যাগ করে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে এবং দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা আর “গলাকাটা রাজনীতি” করবেন না বলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের ভিতর দিয়ে সংসদসদস্য নির্বাচিত হন। সাম্যবাদী দলের অবস্থান পরিবর্তনের পর কমরেড আসাদ্দর আলী আর জাগমুই না করে প্রকাশ্যে সাম্যবাদী দলে তৎপর হন। উল্লেখ্য যে, সাম্যবাদী দলের আত্মপ্রকাশের ঘটনা, বিপ্লবী রাজনীতিকে “গলাকাটা রাজনীতি” বলে আখ্যায়িত করা, মোহাম্মদ তোয়াহার জিয়াউর রহমানের পার্লামেন্টে শপথ গ্রহণ এবং বর্তমানে তাঁর দলের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগদান ইত্যাদি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও এখানে ঐ প্রসঙ্গটি আলোচনা করা সমীচীন নয়।

কমরেড আসাদ্দর আলী তাঁর জীবনে অনেকবার গ্রেপ্তার বরণ করেছেন। আমাদের উপস্থিতিতে তিনি একবার গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তিকাল করেন। ঐদিন রাত থেকেই সাম্যবাদী দলের নেতা হিসেবে কমরেড আসাদ্দর আলী, ন্যাপ (ভাসানী) নেতা লুৎফুর রহমান, পিপলস লীগ নেতা গাজী শফিক আহমদ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সিলেটে পরদিন গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানসহ একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং তদনুযায়ী মাইকযোগে প্রচার আরম্ভ করা হয়। দেশে সামরিক আইন চালু রয়েছে এই অজুহাতে পরদিন সকালে বন্দরবাজার এলাকায় হঠাৎ করে পুলিশ এসে কর্মসূচির প্রচার ও সংগঠিত করার কাজে তৎপর নেতা কর্মীদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। একটি রিক্সায় করে মাইকযোগে প্রচার চালানোরত অবস্থায় দু’জন ন্যাপ সদস্য আহাদুস সামাদ ও মন্মথ রঞ্জন দে হারু কে জনৈক পুলিশের ডিএসপি (এই পদটি বর্তমানে নেই) টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে নির্যাতন চালান এবং জিন্দাবাজার পুরানলেনের মো. আনোয়ার কানু ও বিলপারের মো. তাজিম নামক দু’জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এই সাথে পুলিশ কমরেড আসাদ্দর আলীকেও গ্রেপ্তার করে। একদিকে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুতে শোকাহত, অপরদিকে পুলিশি আক্রমণে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। দুপুরের দিকে সবাই বার লাইব্রেরিতে যাই। জেলা বারের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম জিলানী চৌধুরী ঘটনা শুনে তীব্র প্রতিবাদ ও পুলিশি আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁর সাহসী পদক্ষেপে তৎক্ষণাৎ বার লাইব্রেরি হলে একটি শোক ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে অ্যাডভোকেট গোলাম জিলানী চৌধুরী, ন্যাপ নেতা লুৎফুর রহমান, রিফাকত হোসেন কমরেড, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি নেতা অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন আহমদ সহ সকলে কমরেড আসাদ্দর আলী এবং গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্যদের মুক্তির দাবিতে বার লাইব্রেরি থেকে কোতোয়ালী থানায় যাই। সামরিক আইন বহাল ও মিছিল-সভার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা কোন স্লোগান না দিয়ে নীরবে থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হই ও দেখতে পাই যে, কোতোয়ালী থানার তৎকালীন টিনশেড ভবনের সাধারণ হাজতিদের সাথে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আসাদ্দর আলীকে দাঁড় করিয়ে তালাবদ্ধ কক্ষে রাখা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে অ্যাডভোকেট গোলাম জিলানী চৌধুরী আলাপ করলে তারা জানালেন ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের করার কিছু নেই। অবশেষে চেষ্টা তদবিরের পর এসপি’র কথানুযায়ী দিন পার করে সন্ধ্যায় মুক্তি দিলে কমরেড আসাদ্দর আলী হাজত থেকে বের হয়ে এসে জানান যে, তিনি জীবনে অনেকবার গ্রেপ্তার বরণ করলেও এবারের ন্যায় ইতঃপূর্বে আর কখনো এত বেশি অপমানিত হননি।

জেল-নির্যাতনকে সহ্য করেও কমরেড আসাদ্দর আলী ভুলে যাননি পারিবারিক দায়িত্বরোধ। মৃত্যু শয্যায় থেকে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ ও কদমতলী নিবাসী আব্দুল হামিদ কে ডেকে এনে তাঁর একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র মাহবুব আলী বাচ্চু’র বিয়ের ব্যবস্থা করেন। কমরেড আসাদ্দর আলী নিজপরিবারের সাথে পরলোকগত বড়ভাইয়ের কন্যা ও কন্যার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে একত্রে বসবাস করতেন। যাদের স্থান ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীরে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাদের মধ্যে সহায় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে যান। ভ্রাতুষ্পুত্র, কন্যা, ভাতিজির দিকের নাতি-নাতনীদের প্রতি কমরেড আসাদ্দর আলীর অকৃত্রিম স্নেহ মমতা ও দায়িত্ববোধ সর্বজনবিদিত। তাইতো তিনি তাদের প্রতি পালন করে গিয়েছেন সর্বসময় দায়িত্ব। জানিনা তারা আজ কমরেড আসাদ্দর আলীর প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। জননেতা আসাদ্দর আলী’র নিজ পরিবার সম্বন্ধে দু’একটি কথা জানানো উচিৎ। রাজনৈতিক ব্যতিব্যস্ততার কারণে তিনি অনেকটা বিলম্বে বিয়ে করেন মধুশহীদ মহল্লার শহিদুন্নেছা শান্তিকে। তাঁদের এক কন্যা নাফিজা খানম। পিতা ও মাতা দু’জনের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে কন্যার ডাক নাম রাখেন আশা। সে আজ বিবাহিত ও এক কন্যা শিশুর জননী। তার স্বামী মিসবাহ উদ্দিন। যিনি গড়ে তুলেছেন তার শ্বশুর কমরেড আসাদ্দর আলীর নামে স্মৃতি পরিষদ এবং ওয়েবসাইট। কমরেড আসাদ্দর আলীর ছোট্ট একটি শেষ ইচ্ছে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন ধোপাদিঘীর পূর্বপারে সামান্য কিছু ভূমিতে একটি হল নির্মাণ করতে। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বিনে ভাড়ায় সভা অনুষ্ঠান করবে। মৃত্যু শয্যায় থেকে তিনি বিষয়টি তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফম কামাল সহ আমাদের সকলকে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আজও অপূর্ণ রয়েছে।

জননেতা আসাদ্দর আলীর নিজ বর্ণনা মতে তাঁর পিতৃদত্ত নাম হচ্ছে আছদ্দর আলী। বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, সন্তোষ সহ অন্যান্য স্থানে তিনি ও শ্রমিক নেতা আশিক উদ্দিন চৌধুরী একসাথে অনেক কর্মসূচিতে সিলেট থেকে যেতেন ও মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা হতো। মওলানা ভাসানী তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে তাঁদের দু’জনকে “আসাদ্দার” এবং “আশেক” বলে সম্বোধন করতেন। এভাবেই এক সময়ে তাঁর নিজ নাম “আছদ্দর” এর স্থলে “আসাদ্দর” হয়ে যায়।

১৯৯০ সালের ০২ ফেব্রুয়ারিতে কমরেড আসাদ্দর আলীর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে অবসান ঘটে ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের। ঐদিন সন্ধ্যায় আমাদের সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বালাগঞ্জ তথা অধুনা ওসমানীনগর থানাধীন তাজপুরে নামাজে জানাজা শেষে সমাহিত করা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে তাজপুর অতিক্রমকালে আজও শ্রদ্ধা জানাই দেশপ্রেমিক সাম্যবাদী নেতা আসাদ্দর আলীকে, যেখানে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে।

ভাষাসৈনিক সম্মাননা ২০২০ স্মারকগ্রন্থ ‘শব্দগান রক্তমিতা’য় প্রকাশিত।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.