প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ১৭ আগস্ট, ২০১৮
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর মেজর আব্দুল জলিলকে প্রেসিডেন্ট এবং আসম রবকে সাধারণ সম্পাদক করে আত্মপ্রকাশ ঘটে নতুন রাজনৈতিক দল জাসদের। এই দলের অধিকাংশ নেতারাই ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতারা।
তাঁদের মধ্যে শাহজাহান সিরাজ, মরহুম কাজী আরেফ আহমেদ, মঈনুদ্দিন খান বাদল, মরহুম নুরে আলম জিকু, আব্দুল মালেক রতন, হাসানুল হক ইনু, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, মাহবুবুল হক, সৈয়দ শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাফর সাজ্জাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এরা সবাই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।
জাসদ প্রতিষ্ঠালগ্নের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান যিনি কিছু দিন আগেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত পলিটিক্যাল কমান্ডো বাহিনী অর্থাৎ মুজিব বাহিনীর শীর্ষ ৪ পরিচালকের একজন ছিলেন। অন্য ৩ জন হচ্ছেন, যথাক্রমে বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল হক মনি।
অধ্যাপক আবু সাঈদির লিখা “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড” বইটিতে দেখা যায় ১৯৮১ সালের ২১ মে সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক সদস্য জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখের সামরিক অভ্যুত্থান এবং স্বপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বর্তমান ডেমোক্রেটিক লীগে যোগদানকারী আওয়ামী লীগের তৎকালীন গ্রুপ দায়ী”।
২১শে মে ১৯৮১ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশকারী সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন (সহ-সভাপতি, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা - সাবেক গণবাহিনী, দফতর সম্পাদক ), সাবেক নায়েক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ (সদস্য - বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা)।
তারা সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, “১৯৭৪ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় বিপ্লবী গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বীরউত্তম কর্নেল তাহের হলেন সৈনিক সংস্থার প্রধান। জাসদের তরফ থেকে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকলেন হাসানুল হক ইনু। ক্যান্টনমেন্টে গোপনে গঠিত করা হতে লাগলো বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট।
১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে জাসদ দেশব্যাপী এক হরতাল আহবান করে এবং সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কর্মসূচি দেয়। হরতালের পূর্বদিন জাসদের অন্যতম কর্মী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র সাহা বোমা বানাতে গিয়ে মারা যান। তার নামানুসারে এই বোমার নাম রাখা হয় নিখিল বোমা।
১৯৭৫ সনের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেন এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমতাবস্থায় হীনবল ও উপায়ন্তরহীন জাসদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবের কাছে বাকশালে যোগদানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু শেখ মুজিব তখন এই প্রস্তাবকে আমল দেননি।
ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে জাসদ নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অফিসারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলা হয় বিপ্লবী ফোরাম। এই ফোরামের ঘন ঘন বৈঠক বসতে থাকে এখানে সেখানে। গুলশানের এক বাড়িতে বসে নির্ধারিত হয় অভ্যুত্থানের নীল নকশা। সেই বৈঠকেই জাসদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করার প্রস্তাব প্রদান করা হয়।
এই নীল নকশা মোতাবেকই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হন।
জাসদ নেতারা বিশেষত গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর জিপে করে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কুরিয়ারদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয়, এই অভ্যুত্থান জাসদের স্বপক্ষে অভ্যুত্থান এবং এখনকার বিপ্লবী দায়িত্ব হলো বিভিন্ন ফাঁড়ি ও ট্রেজারিসমূহ থেকে যতটা সম্ভব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা।
এই নির্দেশ অনুযায়ী মোহাম্মদপুর ফাঁড়ি ও নারায়ণগঞ্জের একটি ফাঁড়ি প্রকাশ্য লুট করা হয় এবং লুণ্ঠিত অস্ত্র শস্ত্র তোলা হয় পিটার কাস্টার্সের এলিফেন্ট রোডস্থ বাসভবনে।
পরবর্তীকালে পিটার কাস্টার্স এই অস্ত্র-শস্ত্রসহই গ্রেপ্তার হন। ভারত থেকে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে বহিষ্কৃত পিটার কাস্টার্সের সঙ্গে জাসদের কি সম্পর্ক ছিল তা জাসদ নেতারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেনি। তবে জেলখানায় পিটার কাস্টার্স প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতো যে, সে জাসদকে চল্লিশ লক্ষ টাকা দিয়েছে। জাসদের কেউই এর কোন প্রতিবাদ করতো না।
প্রসঙ্গত: ১৫ই আগস্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশব্যাপী তিনটি ফাঁড়ি লুট করা সম্ভব হয়।
শুধুমাত্র মানুষের কাছে পরিচিতি লাভের জন্যই জাসদ বোমাবাজি, হত্যা, খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস করতে শুরু করে। জাসদ গঠনের পর থেকে আড়াই বছরে প্রায় প্রতিদিনই ট্রেন ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, পুরো গ্রাম ঘিরে গণডাকাতি, হাটবাজার ঘিরে প্রকাশ দিবালোকে শ শ লোকের ওপর একযোগে হামলা, লুট ও ডাকাতির খবর পাওয়া যেতো।
এমন দিনও গেছে যে, একই দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪/৫টি ব্যাংক ডাকাতির খবরও মিলতো। ১৯৭২ সাল থেকে রাস্তায় রাস্তায়, ঘর-বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সর্বত্র ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস -জাসদ’ এই বাণী চিকা মারা থাকতো।
তারা দাবি তোলেন জনগণের ৮% সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্পদের ৮৫% লুট করে নিয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করছে। (জাসদের ১৯৭৩ সালের ঘোষণাপত্র দ্রষ্টব্য)। জাসদ নিজেকে সত্যিকারের সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট লীগ (BCL) এর গণ সংগঠক হিসাবে দাবি করে। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট লীগ গোপন গঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন সিরাজুল আলম খান।
তবে মজার ব্যাপার হলো স্টালিনের চেয়েও বড় কমিউনিস্ট সিরাজুল আলম খান এখন ক্যাপাটালিস্ট আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা।
যুদ্ধকালীন সময় থেকে জাসদের জন্ম পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট লীগ-ই মূলত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট লীগ কর্তৃক ‘গণকন্ঠ’ নামে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে যা প্রকৃতপক্ষে জাসদ-এরই মুখপত্র। কবি আল মাহমুদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।
শেখ মুজিব পুত্র শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি সংক্রান্ত খবরটি প্রথম এই গণকন্ঠে তীব্র বিদ্রূপাত্মক ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে সম্পূর্ণই মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়। সিরাজ সিকদার ও সিরাজুল আলম খান পন্থীরা শুধুমাত্র ‘৭৪ সালেই ৫ জন জাতীয় সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে।
সেই জাসদের দুই কর্ণধার বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের আবার বিরাট কেউকেটা। লীগের চেয়েও বড় লীগ।
একজন হলেন মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু , যিনি স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ট্যাংকের উপর নেচে বন্দুক উঁচিয়ে উল্লাস করেছিলেন। উল্লাসের ছবি ইন্টারনেটে এখনও পাওয়া যায়। । ১৫ আগস্টের পর ইনুর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রচারিত লিফলেটের শিরোনাম ছিল “খুনি মুজিব খুন হয়েছে অত্যাচারীর পতন অনিবার্য"
আরেকজন হলেন, ড. অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর ভিসি হয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাই কর্ণেল তাহের, গণবাহিণীর চীফ কামান্ডার ছিলেন। সমারিক অফিসার হলেও তৎসময়ের রাজনীতির আন্ডারগ্রাউন্ডের আলোচিত চরিত্র। বঙ্গবন্ধুর হত্যা থেকে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায়ন পর্যন্ত ক্ষমতার নানা পটপরিবর্তনে যার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোরালো।
আর হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি, এখন তো সেখানে মাজার হবে, উচিত ছিল লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া”।
কথিত আছে যে ৭৪ সালে জাসদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ী ঘেরাও কর্মসূচীতে তিনি নিজের হাতে স্টেনগানের গুলিবর্ষণ পর্যন্ত করেছিলেন।
এরই নাম রাজনীতি, সবচেয়ে বড় রঙ্গশালা।
তথ্যসূত্র:
১. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা ॥ লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি
২. জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি ॥ মহিউদ্দিন আহমদ
৩. ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য