আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ফকির মরলে বাত্তি জ্বলে মুন্সি মরলে জ্বলেনা

রাজেশ পাল  

এই দেশ একদিন আউল, বাউলের দেশ ছিলো। নৌকার মাঝি প্রাণ খুলে গেয়ে উঠতো ভাটিয়ালি, গরুর গাড়ির চালক ভাওয়াইয়া, মাজারে আখড়াতে মুর্শিদী, মারফতি, জারি, সারি। মন্দিরে মন্দিরে ঢোলের সুরে মেতে উঠতো কীর্তনিয়ারা। এদেশের মাটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন লালন ফকির, হাছন রাজা, রমেশ শীলেরা।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক বলে বাংলা লোকসংগীতে ভাটিয়ালি সুরের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক দেশের জাতীয় চরিত্র যেমন প্রধানত তার নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তেমনি লোকসংগীতও প্রধানত দেশের প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি সকল অঞ্চলে এক নয় কোথাও নদীবিধৌত, কোথাও অরণ্যাকীর্ণ; আবার কোথাও নিরস প্রস্তরভূমি, কোথাও বা তরাই অঞ্চল।

এসব কারণে লোকসংগীতের সুর সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করলেও তা মুখ্যত আঞ্চলিক; যেমন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, পূর্বাঞ্চলের ভাটিয়ালি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাউল-মারফতি ইত্যাদি। যে অঞ্চলের জীবনধারা যেভাবে গড়ে উঠেছে, সে অঞ্চলের লোকসংগীতও সেভাবেই সৃষ্টি ও বিকশিত হয়েছে।

দেশে বিভিন্ন সময়ে শ্রোতাদের বারেবার মুগ্ধ করেছে এরকম অসংখ্য লোকসংগীত। যাতে বর্ণিত হয়েছে পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তার মহিমাই।

ফকির বাউল দীন ফকিরের কণ্ঠে শুনেছি-

"ও শ্যাম রে তোমার সনে
একেলা পাইয়াছি রে শ্যাম
এই নিঠুর বনে
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম
একেলা পাইয়াছি হেতা পলাইয়া যাবে কোথায় চৌদিকে ঘিরিয়ারে রাখবো।।
সব সখি সনে
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম"

কাঙাল হরিনাথের গানে শুনেছি-

"হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল
পার কর আমারে!
তুমি পারের কর্তা শুনে বার্তা
ডাকি হে তোমারে।
হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হল
পার কর আমারে"

লালন ফকির খুঁজেছেন স্রষ্টাকে-

"বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।।
গিরাম বেড়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে।"

অথবা,

"কে বোঝে মওলার আলেকবাজি।
করছে রে কোরানের মানে
যা আসে যার মনের বুঝি।।
একই কোরান পড়াশুনা
কেউ মৌলবি কেউ মওলানা
দাহেরা হয় কত জনা
সে মানে না শরার কাজি।।
রোজ কেয়ামত বলে সবাই
কেউ বলে না তারিখ নির্ণয়
হিসাব হবে কি হচ্ছে সদাই
কোন কথায় মন রাখি রাজি।"

দ্বিজ ভূষণ এর বৈষ্ণব গীতিতে শুনি-

"কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে, মনরে……মনরে……
কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে,
আমরা পেয়েছি ভাই মানব জনম
এ জনম চলে গেলে,
এ জনম চলে গেলে আর পাবো না
না না না আর মিলবে না
তাই হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আমরা আর পাব না, আর পাব না।
“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”

রহমান বয়াতি গেয়েছিলেন-

"মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি
কোন মিস্ত্রি বানাইয়াছে,
একবার চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া
জনম ভইরা চলতেয়াছে"

কিংবা বাউল শফি মণ্ডল এর-

"দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিসনা,
ছেড়ে দে নৌকা মাঝি, যাবো মদিনা "

এদেশে লেখালেখি করার অপরাধে ব্লগারদের খুন করা হয়েছে, লেখকদের করা হয়েছে দেশান্তরী। ভাঙা হয়েছে বাউলের ভাস্কর্য, স্থানান্তরিত হয়েছে জাস্টিসিয়া। বাউল শরিয়ত সরকার তো নাস্তিক নন। তিনি শুধু নিজের ব্যক্তিগত মত অনুসারে আল্লাহর মহিমাই গেয়ে চলেন। আর জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নিজ নিজ মত অনুসারে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার অধিকারতো প্রত্যেকটি নাগরিককে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানই দিয়েছে তাইনা?

মোল্লাতন্ত্রের হুংকারে আজ প্রকম্পিত বাংলাদেশ। শরিয়ত সরকার জেলে যান। আর অন্যধর্মাবলম্বী আর নারীদের নিয়ে অশ্লীল কটূক্তিকারী আমীর হামজা, মনোয়ার, জিহাদি, আজহারী, হাটহাজারী ইত্যাদি ইত্যাদি টিকে থাকে বহাল তবিয়তেই। আজ যখন দেখি শুধুমাত্র ভিন্নভাবে নিজের মতো করে স্রষ্টার গুণকীর্তন করা এই বাউল ফকিরদের দেখি জেলের কারায় আবদ্ধ থাকতে, তখন আবার সেই বাউল শিল্পী রশিদ বাউলের কণ্ঠেই বলতে ইচ্ছে হয়-

"ফকির মরলে বাত্তি জ্বলে
মুন্সি মরলে জ্বলেনা
এই মানুষে আল্লাহ থাকে
কানার দলে দেখে না।"

অবিলম্বে বাউল শিল্পী শরিয়ত সরকারের মুক্তি চাই।

রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ