প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ০৮ এপ্রিল, ২০১৬
প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো আরো একজন অনলাইন এক্টিভিস্টকে। এবারের হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদকে।
সামাদ অনলাইন এক্টিভিস্ট হলেও ব্লগার ছিলেন না। মূলত: তিনি লেখালেখি করতেন ফেসবুকে। তাঁর অন্য পরিচয় তিনি ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী, জড়িত ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাথেও।রাজাকারের ফাঁসির দাবীতে উত্তাল ছিলেন অনলাইন ও অফলাইনে। এর আগে যে কয়েকজন ব্লগার খুন হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে যেরকমভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি আহত করার অভিযোগ উঠেছে একটি মহল থেকে, সামাদ সে অর্থে আলোচিত কেউ ছিলেন না। তারপরও তাঁকে শিকার হতে হলো হত্যাকাণ্ডের।চাপাতির পাশাপাশি এবারের হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হলো আগ্নেয়াস্ত্র। প্রকাশ্য রাজপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইলো তাঁর মগজ আর মাথার খুলি।
এদেশে বর্তমানে যখন তখন যাকে তাকে নাস্তিক ট্যাগ দেয়া অনেকটা ফাঁসানে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই তূলে তাকে হত্যা করতে ছুটে আসেন কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি।একবারও বিবেচনা করে দেখেননা লোকটি আসলেই নাস্তিক কিনা। কেননা নাস্তিক হত্যাকাণ্ডকে অনেকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখা হয় আমাদের সমাজে। কেননা হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে অধিকাংশ জনসাধারণই এখানে অধিক মাত্রায় ধর্মপরায়ণ। যদিও ধর্মীয় বিধিবিধান ব্যক্তিগত জীবনে তেমন যথাযথভাবে ফলো করেননা বেশীরভাগই। কিন্তু যখনই ধর্মীয় অবমাননার প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই হঠাতই অর্জুন, সালাউদ্দীন বা নাইট টেম্পলারের রূপে রণোম্মাদ হয়ে ওঠেন অনেকেই। যদিও নিজের হাতে খুন করার মতো ব্যক্তি খুব বেশী নেই, কিন্তু সমর্থন রয়েছে বেশীরভাগেরই। আর সেই সুযোগেই একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছেন অনলাইন এক্টিভিস্টরা।
এদেশে মুক্তচিন্তার উপর আঘাত নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পরপরই এর সূচনা। স্বাধীনতার পরপরই কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ব্যাপক ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়। যার কারণে সরকার তাঁকে প্রথমে গ্রেফতার করেন,পরে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। আজ পর্যন্ত তিনি আর ফিরে আসেননি। একইভাবে দেশ ছাড়া হন তসলিমা নাসরিন।
চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে হামলা চালানো হয় হুমায়ুন আজাদের উপর,যা তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এরপর কিছুদিন বিরতি গেলেও আবারো শুরু হয় লেখক হত্যা। তবে এবারের টার্গেট হন ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিস্টরা। মূলত: কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে ওঠার সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফেসবুক। আর চায়না মোবাইলের কল্যাণে তা পৌঁছে যায় একেবারে আমজনতার হাতে। ফলে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি শুরু হয় ব্যাপক প্রোপাগান্ডা আর ঘৃণার সম্প্রসারণ। এরফলে বিভ্রান্ত হয় একটি গোষ্ঠী। শুরু হয় হত্যার সিরিজ।
অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, রাজীব হায়দার, নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়,প্রকাশক দীপন সহ খুন হয়ে যান বেশ কয়েকজন মুক্তচিন্তার এক্টিভিস্ট। যার সর্বশেষ সংযোজন নাজিমঊদ্দদীন সামাদ।
একটি ব্যাপার লক্ষণীয় শুধু যে নাস্তিকরাই এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। দিনাজপুরের খ্রিষ্টান পাদ্রী,পঞ্চগড়ের হিন্দু পুরোহিত, আর মাওলানা ফারুকীর মতো পূর্ণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরাও এসব নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পাননি। আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নিয়মিতভাবেই চলছেই হত্যা,ধর্ষণ,লুটপাটের মহোৎসব। বোমা ফুটছে শিয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশে। আগুন জ্বলছে পাহাড়ে। এককথায় চারিদিকে এক দুঃসহ পরিস্থিতির ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে বাংলাদেশ।
আর এর মাঝেই সামাদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দিলেন যে, সামাদের লেখাগুলোই নাকি যাচাই করে দেখা হবে। তার মানে কুপিয়ে মানুষ হত্যার চেয়ে লেখালেখি করাটাই অনেক বড় অপরাধ হয়ে গেছে এদেশে। ব্যাপারটা অনেকটা ধর্ষণের জন্য ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতার কাপড়চোপড়কে দায়ী করার মতোই। ব্যাপারটা এর আগেও ঘটেছে শাপলা চত্বরের ঘটনা পরবর্তীতে চার ব্লগারের গ্রেফতারের সময়েও। এভাবে হত্যাকাণ্ড যারা ঘটাচ্ছে তাদের কাছে ভুল মেসেজ যাচ্ছে যে, তারা যা করছে, ঠিকই করছে।
আর তাই রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন অপরপক্ষের উপরেই। ফলে সৃষ্টি হয়েছে একধরণের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যা উৎসাহিত করছে আরো অধিক হত্যার পরিকল্পনাকে। কেননা অপরাধের সুষ্ঠু বিচার ও কঠিন শাস্তির বিধান না থাকলে যেকোনো সমাজেই স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায় অপরাধ।এটা অপরাধ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান সূত্র। আর জেনে শুনে সেই আগুনেই ঘৃতাহুতি দিল মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য।যাতে প্রকারান্তরে উৎসাহিতই হলো সামাদের খুনিরা।
পরিশেষে এটাই বলবো , কবিগুরু বলেছিলেন, “তোমার এ ভার দিয়েছো যাহারে ,তাহারে বহিবারে শকতি” কাজেই , সেই শকতিতে বলীয়ান হয়ে ভিকটিমদের অপরাধ সন্ধান না করে খুনিদের সন্ধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়। যে কাজের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আপনাকে আসীন করা হয়েছে। অনেক তো হলো , আর যেন বিচারের বাণী নিভৃতে না কাঁদে সেই প্রত্যাশাই করি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য