আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

প্রতিরোধ বাহিনীর সেই সব ‘নির্বোধ’: যাদের খবর কেউ রাখেনি

রাজেশ পাল  

হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘বাঙালির স্মৃতি হলো গোল্ডফিশের। খুব সহজেই তাই তারা ভুলে যায় সব’ যেমন আজ খুব কম মানুষই মনে রেখেছেন প্রতিরোধ বাহিনীর সেই বীর যোদ্ধাদের কথা। সেই প্রতিরোধ বাহিনী যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে গড়ে তুলেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ।

এই প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সকলেই ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে নেতার ডাকে একদিন তাঁরা হাতিয়ার তুলে নিয়েছিলেন একাত্তরে, সেই পিতৃসম নেতার হত্যার বদলা নিতে আবারো হাতে হাতিয়ার তুলে নেন তাঁরা। একাত্তরে বুক পেতে দিয়েছিলেন পাকবাহিনীর রাইফেলের সামনে। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে আবারো সম্মুখ সমরের মুখোমুখি হলেন স্বদেশী পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর।

সারাদেশে যখন কঠোর সামরিক শাসনের ভয়ে অনেকের নিজ ঘরে বসে কথা বলার সাহসটুকুও ছিলোনা, সেই সময়ে দেশের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে তাঁরা শুরু করেন সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া এই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ স্থায়ী হয় ১৯৭৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। যার নেতৃত্বে ছিলেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, বগুড়ার আব্দুল মালেক খসরু, রাঙামাটির দীপঙ্কর তালুকদার প্রমুখ। প্রথম দিকে পুলিশ-বিডিআরের কেড়ে নেয়া অস্ত্র দিয়েই লড়াই শুরু করলেও পরে ভারতীয় সামান্য সহায়তাও তারা পান। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

মেঘালয় সীমান্তের অভ্যন্তরে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চান্দুভূঁইতে গড়ে উঠে সদর দপ্তর, এবং উক্ত দপ্তরে বসে পুরোটা সময় সর্বাধিনায়কের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রধান অর্থ নির্বাহী ছিলেন গারো আদিবাসী চিত্ত রঞ্জন সাংমা, প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা ছিলেন কামারখালীর অধিবাসী আব্দুল হক। এক সময় সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপূর থানার ভবানীপুরে। ওই এলাকা ছিল বাংলাদেশের ছিটমহল এবং তাতে যেতে হলে ভারতীয় সীমানা পার হয়ে যেতে হতো বলে বাংলাদেশি সেনা/বিডিআর কিংবা পুলিশের কারো পক্ষে সেখানে পৌঁছানো ছিল অসম্ভব। সেক্টর জিওসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, টাঙ্গাইলের সেলিম তালুকদার, সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রশান্ত কুমার সরকার। কোয়ার্টার গার্ডের অধিনায়ক ছিলেন শরীফুল ইসলাম খান, ডিফেন্স কমান্ডার সাইদুর রহমান। উক্ত হেড কোয়ার্টারের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু সাব সেক্টর স্থাপন করা হয়।

১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানায় অভিযান চালালে ওসি তোফায়েলসহ ৮ জন পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালিয়ে যায় এবং ২৩ জানুয়ারি কলমান্দা থানায় আক্রমণ করে তার দখল নেয়ার পরে যোদ্ধারা আশরাফ আলী এবং তার স্ত্রী সুলতানা আশরাফকে আটক করে নিয়ে যায়। ২০ জানুয়ারি রংরা এর সেক্টর কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিকের নেতৃত্বে যোদ্ধা আকস্মিকভাবে হানা দেয় বারোমারি এবং ফারাংপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে। মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’টি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যোদ্ধারা।

২০-২১ জানুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশদ সংবাদ প্রকাশিত হয় এই যুদ্ধ নিয়ে। শিরোনাম করা হয়, ‘কংশ নদীর উত্তরাংশের ৩০০ বর্গমাইল এলাকা বাঘা বাহিনীর দখলে শেখ মুজিব হত্যার প্রতিরোধ চলছে।’

আনুমানিক ৪ বছর স্থায়ী এই প্রতিরোধ যুদ্ধে "জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু" স্লোগান দিয়ে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দেন ১০৯ জন মুজিবসেনা। আহত হন তিন শতাধিক। অস্ত্র ও গোলাবারুদের অপ্রতুলতা , বৈদেশিক সাহায্যের অভাব আর ব্যাপক লোকবল ক্ষয়ের কারণে ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে এই সংগ্রাম। সেসময় জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের প্রতি আত্মসমর্পণের বদলে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে কর্নেল তাহেরের মতোই তাঁকে বিশ্বাস করার একই ভুল করেন তাঁরা। জেনারেল জিয়া বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে তাঁদের প্রথম সারির ৮১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আহতদের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা যান পরবর্তীকালে। আত্মসমর্পণকারীদের অনেকেই নিখোঁজ হন রহস্যজনকভাবে। অনেকের ধারণা তাদের স্রেফ খুন করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিলো।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে তাদের ৯১ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন বগুড়ার আবদুল খালেক খসরু ও নজিবুর রহমান নিহার, গাইবান্ধার ইবনে সাউদ, রেজাউল করিম, মিজানুল হক মুকুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রাজ্জাক, আলী আযম আলমগীর, মো. বাবুল, মো. সোলায়মান ও আবদুর রহিম আজাদ, কুড়িগ্রামের রেজাউল করিম-২, নূরুল ইসলাম ও নূরুল আমিন, নেত্রকোনার আবদুল খালেক, রাধারমণ রায় ঝন্টু, বামুন সরকার, রজব আলী, আবুল কাশেম, হামিদুল ইসলাম, ফজর আলী, শান্তি বিকাশ সাহা পল্টু, আবদুল হেকিম, মুসলিম উদ্দিন তালুকদার ও সুব্রত, টাঙ্গাইলের সাখাওয়াত হোসেন মান্নান ও সৈয়দ নূরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, কুমিল্লার সুশীল ভৌমিক বেলু, সুনামগঞ্জের নিরানন্দ দাশ, মতিলাল দাশ, আখলমন মাঝি, বলরাম সরকার, শেরপুরের বিপ্লব কুমার দে দুলাল, দুলাল মিয়া, মনোরঞ্জন সরকার, হাবিবুর রহমান, বীরেন্দ্র চন্দ্র পাল, কছর আলী, আলী হোসেন, শওকত আলী, মোতালেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল, রুস্তম আলী ও মোজাম্মেল হক, জামালপুরের নজরুল ইসলাম ও আলতাফুর রহমান, ময়মনসিংহের আবদুল হামিদ, আবদুল আজিজ, সুশীল চন্দ্র দত্ত, রঞ্জিত কুমার এস, মজিবুর রহমান খান, সুবোধ চন্দ্র ধর, আলকাস উদ্দিন সরকার, দ্বীপাল চন্দ্র দাশ, জোবেদ আলী ও সিরাজুল ইসলাম।

শহীদদের ২৫ জন আদিবাসী। তারা হচ্ছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রঞ্জিত সাংমা, অনন্ত বর্মণ, জয়েশ্বর বর্মণ, সপ্রু সাংমা, কাশেম সাংমা, নিরঞ্জন সাংমা, পিটারসন সাংমা, প্রাণবল্লভ বর্মণ, প্রটিন দিও, শ্রীদাম রিছিল ও চিত্তরঞ্জন ডালু, শ্রীবর্দী উপজেলার সম্রাট সাংমা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ফনেস সাংমা, তপন চাম্বুগং, অ্যালিসন মারাক, গোবিনিক মারাক, সুদর্শন মানকিন, হারু সাংমা, হযরত সাংমা, জবিনাশ তেলসী, অগাস্টিন চিছিম, সুধীন কুবি ও ডমিনিক চাম্বুগং, নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার হেনরি সাংমা এবং ধোবাউড়া উপজেলার পংকজ আজিম।

এই কিছুদিন ধরে ‘নদভী- রিজিয়া’ ইস্যুতে বেশ রসালো বিতর্ক চলছে অনলাইনে। তাই ‘হাইব্রিড’ আর ‘বাই-বর্ণ’-দের পার্থক্যটা ঠিক কোন জায়গায় সেটা ‘সুবোধ’-দের দেখানোর জন্যই সেদিনের এই ‘নির্বোধ’-দের কিছু কাহিনী তুলে ধরলাম!

কৃতজ্ঞতা: সাইফুর মিশু; বাংলাদেশ প্রতিদিন; ঢাকা টাইমস।

রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ