সিলেটটুডে ডেস্ক

২৯ জুলাই, ২০১৬ ১৪:১৬

তেলাপোকাও দুধ দেয়, তাও গরুর দুধের চার গুণ পুষ্টিকর!

হ্যাঁ, আরশোলাও (তেলাপোকা) দুধ দেয়! তাদের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়! তবে যা-ই রটুক না কেন, আরশোলার দুধ বাজারে আসছে না।

‘দুধের বাজারে’ তেমন আলোড়নের সম্ভাবনা না থাকলেও, আরশোলার মতো পতঙ্গ যে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো দুধ দেয় আর সেই দুধ তাদের বাচ্চাদের খাওয়ায়, এই আবিষ্কার রীতিমতো চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আর পতঙ্গ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে বিভাজন রেখাটাকে যে মুছে দিয়েছে আরশোলা, সেই সত্যটাকে সবার সামনে এনে নজর কেড়ে নিয়েছেন এক বাঙালি নারী। যিনি প্রথম দেখালেন, শুধুই ডিম পাড়ে না, আরশোলার একটি বিশেষ প্রজাতি তাদের বাচ্চাদের স্তন্যপানও করায়। ভ্রুণ অবস্থাতেই।

আমাদের ধারণা আর বদ্ধমূল বিশ্বাসকে সজোরে ধাক্কা দেওয়া এই আবিষ্কার এও জানিয়েছে, মানুষের স্তনদুগ্ধ বা গরু-মোষ, ছাগল, ভেড়ার দুধের চেয়ে আরশোলার দুধের পুষ্টিগুণ অনেকটাই বেশি।

তবে ওই বিশেষ প্রজাতির আরশোলা সংখ্যায় এতটাই অপ্রতুল যে, তার দুধ দিয়ে জনসংখ্যার বিপুল চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় কখনওই। প্রচলিত দুধের বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব না হলেও, অত্যন্ত পুষ্টিকর সেই দুধের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বানানোটাই এখন অন্যতম লক্ষ্য গবেষিকার।

নজরকাড়া গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান-পত্রিকা ‘জার্নাল অফ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ক্রিস্টালোগ্রাফি’-র জুন সংখ্যায়। মূল গবেষক, বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর সিস্টার অর্গানাইজেশন ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন’-এর সঞ্চারী বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছে্ন, ডিম পাড়ার বদলে যে বিশেষ প্রজাতির আরশোলা দুধ দেয় আর তাদের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়, তার নাম ‘ডিপলোপ্‌টোরা পাঙ্কটেটা’। এদের পাওয়া যায় একমাত্র হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে।

প্রজননের পর এই আরশোলাদের একই সঙ্গে ৯ থেকে ১২টি ডিম জন্মায়। মহিলাদের যেমন ইউটেরাস থাকে, তেমনই ওই আরশোলাদেরও থাকে ‘ব্রুড স্যাক’। সেখানেই ওই ডিমগুলি জমা থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ওই ‘ব্রুড স্যাক’-এ ডিমগুলি জমা হওয়ার ২০ দিন পর থেকেই ওই ভ্রুণগুলোর (এমব্রায়ো) মধ্যে দুধের ক্ষরণ হতে শুরু করে। আর ভ্রুণ (ডিম) গুলো তখনই সেই দুধ খেতে শুরু করে। তবে সব দুধটা তারা এক বারে খেয়ে সাবাড় করে দেয় না। বেশ কিছুটা করে জমিয়ে রাখে। সেই দুধটাই জমে গিয়ে ওই ভ্রুণের মধ্যে কেলাস (ক্রিস্টাল) হয়ে যায়। এখানেই মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সঙ্গে তফাৎ ওই আরশোলাদের। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরে দুধটা আসে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর। আর এই বিশেষ প্রজাতির আরশোলাদের শরীরে দুধটা জন্মায় ‘ব্রুড স্যাক’-এ ভ্রুণগুলো জমা হওয়ার পরপরই। সেই ভ্রুণগুলো কতটা দুধ খাবে আর পরে খাওয়ার জন্য কতটা জমিয়ে রাখবে (স্টোরড মিল্ক), তার মধ্যে অদ্ভুত রকমের একটা সাম্যাবস্থা (ইক্যুইলিব্রিয়াম) থাকে।’’

ওই বিশেষ প্রজাতির আরশোলারা যে দুধ দেয় আর তা তাদের বাচ্চাদের খাওয়ায়, সেটা প্রথমে কী ভাবে বোঝা গেল?

সঞ্চারী বলছেন, ‘‘ওই আরশোলাদের ‘ব্রুড স্যাক’-এর ভ্রুণের মধ্যে জমিয়ে রাখা যে দুধটা কেলাস হয়ে থাকে, আমরা প্রথমে তার হদিশ পেয়েছিলাম। পরে দেখেছি, ওই কেলাসটি একেবারেই দুধে বানানো। আমরা কেলাসটির নাম দিয়েছি ‘লিলি-মিপ’। এর মধ্যে প্রোটিন, সুগার, ফ্যাটি অ্যাসিড, কী নেই? তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে প্রোটিন। কম করে তিন রকমের প্রোটিন- ‘লিলি-মিপ-ওয়ান’, ‘লিলি-মিপ-টু’ আর ‘লিলি-মিপ-থ্রি’ তো রয়েছেই, রয়েছে আরও নানা রকমের পেপটাইড। রয়েছে অন্তত দু’রকমের সুগার- ‘এন-অ্যাসিট্যাল গ্লুকোজ অ্যামিন’ আর ‘মেনোজ’ এবং লিপিড। দুধের প্রোটিনের মধ্যে ছোট ছোট ‘পকেটে’ ওই লিপিডগুলো ভরে রাখা আছে। লিপিডগুলো রয়েছে ‘ওলিক অ্যাসিড’ আর ‘লিনোলিক অ্যাসিড’-এর মতো দু’রকমের ফ্যাটি অ্যাসিড হয়ে।’’

কিন্তু এই দুধ কতটা পুষ্টিকর? কতটা খাদ্যগুণ রয়েছে ওই দুধে?

সঞ্চারীর কথায়, ‘‘এটুকু বলতে পারি, গবেষণায় আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ওই দুধ একেবারেই একটি সম্পূর্ণ খাদ্য বা ‘কমপ্লিট ফুড’। ‘ব্যালান্সড ডায়েট’ বা সুষম খাদ্যও। কারণ, তার মধ্যে পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন, সুগার আর ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে একই সঙ্গে। আর তা রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণেই। শুধু তাই নয়, আমরা অবাক হয়ে দেখেছি, মানুষের স্তনদুগ্ধ, বা গরু-মোষ, ছাগল, ভেড়ার দুধে প্রতি একশো গ্রামে যত কিলো ক্যালরি থাকে, আরশোলার দুধে থাকে তার অন্তত তিন গুণ। ক্যালোরির নিরিখে মানুষের দুধের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ পুষ্টিকর আরশোলার দুধ।’’

আসানসোলে জন্ম, রাঁচি ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল-কলেজের পড়া শেষ করে বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’এ পিএইচডি’র পর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন’-এ গবেষণারত সঞ্চারী অবশ্য এখানেই থেমে যাননি। তাঁর আবিষ্কারের সুফলকে আমজনতার হাতে পৌঁছে দিতে শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ।


এই বিজ্ঞান-জার্নালের জুন সংখ্যায় বেরিয়েছে সঞ্চারীর গবেষণাপত্র।

সেই পদক্ষেপটা কী?

সঞ্চারীর কথায়, ‘‘আমরা শুধু আরশোলার দুধ আবিষ্কার করেই থেমে নেই। তাদের শরীরের ভেতর দুধের ক্ষরণের জন্য দায়ী যে জিন, আমরা সেটিকেও চিহ্নিত করেছি। ওই জিনটিই আরশোলার ‘ব্রুড স্যাক’-এ প্রোটিন সংশ্লেষে মূল ভূমিকা নেয়। আমরা সেই জিনটিকেই এ বার গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে বানিয়ে সেটাকে ইস্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখতে চাইছি, সেখানেও ওই জিনটি একই ধরনের প্রোটিন বানাতে পারে কি না। যদি পারে (আমাদের বিশ্বাস, পারবেই), তা হলে, আগামী দিনে অনেক অনেক বেশি পুষ্টিকর ‘প্রোটিন শেক্‌স’, উন্নততর ক্যাপস্যুল, ট্যাবলেট আমরা বানাতে পারব।’’
    
তবে আরশোলার দুধ নিয়ে যে রকম শোরগোল পড়ে গিয়েছে, সেটা যে অনেক অনেক দূরের ‘স্বপ্ন’, তার প্রমাণ মিলেছে, সঞ্চারীরই সহযোগী গবেষক, বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন’-এর সিনিয়র প্রফেসর সুব্রহ্মণ্যম রামস্বামীর কথায়। রামস্বামী বলছেন, ‘‘এই নতুন প্রোটিনের আবিষ্কার আর তার থেকে পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করার মধ্যে একটা লম্বা পথ এখনও হাঁটা বাকি রয়েছে। এখন ইস্টে এটা কতটা কার্যকরী হয়, দেখতে হবে। দেখতে হবে, আরশোলার শরীরের ভেতর আর ইস্টে তা সমান ভাবে কার্যকর হয় কি না। দেখতে হবে ইস্টে আরও অনেক বেশি পরিমাণে সেই প্রোটিন বানানো যায় কি না। দেখতে হবে, ইস্টেও অমন কেলাস হয় কি না। দেখতে হবে সেখানে সুগারের গঠনের কোনও পরিবর্তন হয় কি না।’’

ফলে, এখনও অনেক অনেক দূর যেতে হবে সঞ্চারীকে।

তবে মানতেই হবে, জয়ের পথে তাঁর প্রথম মাইলস্টোনটা ছুঁয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন সঞ্চারী।

সূত্র : আনন্দবাজার

আপনার মন্তব্য

আলোচিত