আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৩ জুন, ২০১৫ ১৬:১৯

'সতীদাহ আইনেরও স্বাক্ষী বিধানসভা' বললেন মমতা

শোনা যায়, ঘনিষ্ঠদের অসুখ-বিসুখে ডাক্তারি করেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের নীতিশিক্ষা দিতে আস্ত বইও লিখে ফেলেন। কিন্তু গোল বাধল, বিধানসভা কক্ষে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের শিক্ষা দিতে গিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার বললেন, ‘‘ভুলে গেলে চলবে না, সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইনও সবার আগে পাশ করেছিল এই বিধানসভা।’’

এর আগেও নানা পরিস্থিতিতে নিজের মতো করে ইতিহাসের এমন সব ‘তথ্য’ মমতা উপহার দিয়েছেন, তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাঠ্যবইতে যার হদিস মিলবে না। কখনও ধর্মতলায় (সিদো-কানহু ডহরে) সমাবেশে সিদো-কানহুর সঙ্গে ডহরবাবুর পরিবারেরও খোঁজ করেছেন। কখনও দাবি করেছেন, ফলের রস খাইয়ে গাঁধীজির অনশন ভেঙেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কারও কারও কাছে এ সব সরস কৌতুকের খোরাক মনে হলেও অনেকেই ভেবেছেন, এগুলো হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলা ‘ভুল’ কথা। এ নিয়ে জল্পনায় না যাওয়াই ভাল।

কিন্তু শুক্রবার বিধানসভার অধিবেশনে সতীদাহ প্রথা নিয়ে মমতার উক্তিকে ওই পর্যায়ে ফেলা যায় না। কারণ, গত ৫ জুন বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উপলক্ষে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের অনুষ্ঠানেও একই কথা বলেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী সে দিন বলেছিলেন, ‘‘বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই বিধানসভায় আমরা তার ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালন করছি। মনে রাখতে হবে, রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে সতীদাহ প্রথা বিলোপের মতো আইনও এই বিধানসভাতেই প্রথম পাশ হয়েছিল।’’ যদিও ইতিহাস বলছে, রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয় ১৮৩৩ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৮২ বছর আগে! তখন অন্তত রাজ্য বিধানসভার অস্তিত্ব ছিল না।

এ দিনের প্রসঙ্গ ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের জমি বিলের বিরোধিতা। তারই সূত্র ধরে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘এই বিধানসভার একটা ঐতিহ্য রয়েছে। সারা ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের জমি বিলের বিরোধিতা করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করছে এই বিধানসভা। অতীতেও বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বিধানসভা। ভুলে গেলে চলবে না, সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইনও এই বিধানসভা সবার আগে পাশ করেছিল।’’

মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘ঐতিহাসিক তথ্যে’ বিস্মিত ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক গৌতম ভদ্রের প্রশ্ন, ‘‘তখন বিধানসভা কোথায়?’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান, এটা ইতিহাসের তথ্য নয়।

তা হলে ইতিহাসের তথ্য কী?

তখন কোম্পানি আমল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর নির্দেশে ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ নিবারণী আইন জারি হল। অবশ্যই রামমোহন রায় ছিলেন নেপথ্যের অন্যতম কারিগর।
পরবর্তী কালে ১৮৬১ সালে রানি ভিক্টোরিয়া গোটা দেশের জন্য সতীদাহ প্রথা রদ আইন জারি করেন। কিন্তু তখনও বিধানসভা কোথায়? ইতিহাসবিদদের পরামর্শ, ১৯৩৬-এ যে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল হয়েছিল, তার সঙ্গে এখনকার বিধানসভাকে
এক করে ফেলা উচিত হবে না। আর দেশের সংবিধান মেনে বিধানসভা হয়েছে ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে।

কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় তো মমতার এ দিনের দেওয়া তথ্য নথিভুক্ত হয়ে থাকল! সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আশা, বিধানসভার মধ্যেই কেউ নিশ্চয়ই প্রসঙ্গটি তুলবেন এবং তার জেরে ইতিহাসের ‘ভুল’ সংশোধন হবে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘অন্তত সেটাই হওয়া উচিত।’’

স্বভাবতই বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যকে অসাবধানতার ভুল বলে উড়িয়ে দিতে রাজি নন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘এ নিয়ে উনি দু’বার এই কাণ্ড করলেন। ওঁর বই ছাত্রছাত্রীদের মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য দেওয়া হয়েছে, ভাবতেই ভয় হয়!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের উক্তি, ‘‘উনি তো এর আগে রাকেশ রোশনকে চাঁদে পাঠিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে ফলের রস খাইয়ে বেলেঘাটায় গাঁধীজির অনশন ভাঙিয়েছেন, লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শেক্সপিয়রের আলোচনা করিয়েছেন। এখন রামমোহনকে বিধানসভায় এনে ফেললেন। ওঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর এমন অসাধারণ প্রজ্ঞা কোথা থেকে এল, তা নিয়ে একটা সিবিআই তদন্ত দরকার!’’ আর কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার প্রতিক্রিয়া, ‘‘মনে হচ্ছে, নতুন করে ইতিহাস পড়তে হবে।’’

তৃণমূলের সাংসদ হলেও সুগত বসু ইতিহাসের শিক্ষক। তাই তাঁর পক্ষেও মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য মানা সম্ভব হয়নি। সংক্ষেপে শুধু বলেছেন, ‘‘সেই সময় বিধানসভা ছিল না।’’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত