সিলেটটুডে ডেস্ক

০৩ মে, ২০১৬ ১৩:২১

কিশোরগঞ্জের ৫ রাজাকারের ৪ জনের ফাঁসি, ১ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

একাত্তরে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যার মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে কিশোরগঞ্জের ৪ রাজাকার সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত; একজনের হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান,  শামসুদ্দিন আহমেদ ও হাফিজউদ্দিন। এদের মধ্যে শামসুদ্দিন আহমেদ ছাড়া বাকি সবাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ, তার ভাই নাসিরউদ্দিন আহমেদ এবং একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার গাজী আবদুল মান্নান ও হাফিজ উদ্দিন। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আজহারুল ইসলামকে। এদের মধ্যে শামসুদ্দিন ছাড়া আর সবাই পলাতক রয়েছেন।

বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার (৩ মে) এই রায় ঘোষণা করে।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর সবাই ছিলেন আসামি।

এছাড়া ২ নম্বর অভিযোগে হত্যার ঘটনায় নাসির; ৫ নম্বর অভিযোগে হত্যার ঘটনায় শামসুদ্দিন; ৬ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা এবং ৭ নম্বর অভিযোগে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মান্নানকে আসামি করা হয়।

একাত্তরে এই পাঁচ আসামি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।

সে সময় কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বিদ্যানগর, আয়লা, ফতেপুর বিল, কিরাটন বিলসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে তারা যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটান, তা এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।

শামসুদ্দিন আহমেদ
স্কুল রেকর্ডের তথ্য অনুযায়ী কিশোরগঞ্জ জেলা বারের সদস্য শামসুদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯৫৬ সালে। বাড়ি করিমগঞ্জ উপজেলার করিমগঞ্জ মধ্যপাড়া (ডুলিপাড়া) গ্রামে।

একাত্তরে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে করিমগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পলাতক থেকে আবারও সমাজের মূল ধারায় মিশে যান শামসুদ্দিন। ১৯৮২ সালে বিএ ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৯১ সালে এলএলবি করেন। তার চার বছর পর তিনি ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি পান।

এই লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৮৫ সাল থেকেই নিয়ামতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধী। তামোনি ভূইয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০০৪ সালে তিনি অবসরে যান।

শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর শামসুদ্দিন ময়মনসিংহ জেলা বারে অ্যাডভোকেট হিসেবে এনরোলমেন্ট পান।

নাসিরউদ্দিন আহমেদ
শামসুদ্দিনের বড় ভাই নাসিরউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক ক্যাপ্টেন। স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী, তার জন্ম ১৯৫৪ সালে।

প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গলবাড়ি হাই স্কুল থেকে নাসিরউদ্দিনের এসএসসি পাশের পরপরই দেশে শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। আর তিনি তখন যোগ দেন রাজাকারের দলে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শামসুদ্দিন ও নাসিরউদ্দিন দুই ভাই সে সময় ট্রেইনিং নেন রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নানের কাছ থেকে। নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়ে ছোট ভাইয়ের মতো স্বাধীনতার পর তিনিও আত্মগোপনে যান।

পরে একময় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন একাত্তরের রাজাকার নাসিরউদ্দিন।  এ কারণে এলাকার মানুষ তাকে ক্যাপ্টেন নাসির নামেও চেনে।

‘অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগে ২০০২ সালে সেনাবাহিনী থেকে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

গাজী আব্দুল মান্নান
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, গাজী আব্দুল মান্নানের জন্ম ১৯২৭ সালে করিমগঞ্জের চরপাড়া গ্রামে।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা এই মান্নানই একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার বনে যান এবং রীতিমতো সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

সহযোগীদের নিয়ে তিনি নিজের এলাকায় নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান বলে আদালতের নথিতে উঠে এসেছে।   

হাফিজউদ্দিন
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার খুদির জঙ্গল গ্রামের হাফিজউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালে। লেখাপড়া করেছেন মাদ্রাসায়।  

একাত্তরে তিনিও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় নানা যুদ্ধাপরাধ ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

আজহারুল ইসলাম
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, আজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৬ সালে, করিমগঞ্জের হাইধনখালি গ্রামে।

হাফিজউদ্দিনের মতো তিনিও মাদ্রাসায় পড়েছেন এবং একাত্তরে রাজাকারের দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত হয়েছেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।

মামলা বিচারিক কার্যক্রম

  • প্রসিকিউশনের তদন্ত দল ২০১৩ সালের ৬ জুন এই পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এক বছর পাঁচ মাস ১৮দিন পর গতবছর ২৪ নভেম্বর তদন্ত কাজ শেষ হয়।
  • তদন্ত চলার মধ্যেই ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার তারেরঘাট সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে ডিবি পুলিশের একটি দল শামসুদ্দিন আহমেদকে  গ্রেপ্তার করে।
  • ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গতবছর ১০ মে এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করলে তিন দিন পর আদালত তা আমলে নেয়।
  • অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গতবছর ১২ অক্টোবর পাঁচ আসামির যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে আদালত।
  • রাষ্ট্রপক্ষে ২৫ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে কোনো সাক্ষী ছিল না।
  • শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন।
  • আসামি শামসুদ্দিনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম মাসুদ রানা। পলাতক অপর চারজনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান শুনানিতে অংশ নেন।
  • প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ১১ এপ্রিল আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত