১৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:৩৯
আজ বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর ২১৪ বছর পর পলাশীর আম্রকাননের অদূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রধানদের শপথের মাধ্যমে বাংলাদেশ যাত্রার এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল রণাঙ্গনের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন।
প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গাতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শপথ গ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে ইপিআর-উইং-এর অধীন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা মনোনিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের এক সংকটকালীন সময়ে ভারতীয় বিএসএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এসে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি এবং মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে বৈদ্যনাথ তলায় (বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতি সৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন।
আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ১৬ এপ্রিল সকাল থেকে সারারাত ধরে মঞ্চ তৈরি, বাঁশ দিয়ে বেষ্টনি নির্মাণ এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙা চেয়ার টেবিল দিয়েই আয়োজন সম্পন্ন করেন। আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে সকাল নয়টার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছান। ইতিমধ্যে দেশী বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। তার মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতীক্ষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারটায়।
মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনছারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
গৌরিনগরের বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াত এবং ভবরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপরে আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক শেখ মো. ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশী বিদেশী সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।
ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং শপথ পাঠ করান।
মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা। এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। তিনি ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।
বক্তব্য এবং শপথ গ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু উসমান চৌধুরী। উপস্থিত জনতার মুহুর্মুহু জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আম্রকানন। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
আপনার মন্তব্য