রাইআন কাব্য

১৬ আগস্ট, ২০১৫ ১৩:৩৮

আপিল নিষ্পত্তির দুই মাসেও প্রকাশ হয়নি মুজাহিদের চুড়ান্ত রায়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিল আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও দুই মাসেও প্রকাশ হয়নি পূর্ণাঙ্গ রায়। আপিল বিভাগ ১৬ জুন চুড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ এ রায় দেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন মুজাহিদ। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সাবেক কোন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেওয়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রথম ফাঁসির চুড়ান্ত রায়। মুজাহিদ ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী।

গত ২৬ জুলাই ২০১৫ জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ হতে পারে। তাঁর সে বক্তব্যের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি রায় প্রকাশ হয়নি।

সে দিন মাহবুবে আলম বলেছিলেন- মুজাহিদের মামলায় সব বিচারপতি ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। কেবল একজন বিচারপতি রায় লিখবেন। কোন বিচারপতি দ্বিমত পোষন করেননি। এসব দিক বিবেচনা করে একজন আইনজীবী হিসেবে এটর্নি জেনারেল অনুমান করছেন, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়া যাবে।

এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে। রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার এটা প্রথম রায়। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি চতুর্থ মামলা, যার আপিল নিষ্পত্তি হলো।

৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ শুধু ৬ নম্বর অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আর ৭ নম্বর অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এছাড়া ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

৩ নম্বর অভিযোগে আগেই ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সাজা আপিল বিভাগও বহাল রেখেছেন। ৫ নম্বরে সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের নির্যাতন ও কাউকে কাউকে হত্যার অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রয়েছে।

রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিজ দেশের নাগরিক সেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে এমন নজির নেই। ১৯৭১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষক, চিকিৎসক, দেশের সাংবাদিকদের হত্যার পেছনে জড়িত ছিল আল-বদররা। মুজাহিদ ছিল তাদের নেতা।’ আজকের রায়ে সারা দেশের বুদ্ধিজীবীসহ সব নাগরিক খুশি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

যে অভিযোগে আপিল বিভাগ ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন :
অভিযোগ- ৬: একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীকালে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনের পর সদস্যরা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতেন। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে ওই আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মুজাহিদের। সেখানে নিয়মিত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।

ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির দণ্ড থেকে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ড দিলেন যে অভিযোগে:
অভিযোগ- ৭: একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্যরঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করে। পরে উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকার বিনিময়ে স্বামীর মুক্তি চাইলেও মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকাররা সবাইকেই হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীলকুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে। হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনিল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

আপিল বিভাগ যে অভিযোগ থেকে খালাস দেন:
অভিযোগ- ১: পাকিস্তানের বাঙালি সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ৫ নম্বর চামেলিবাগের ভাড়া করা বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয় ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। এর পর তার আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ- ৪: একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে। পরে তাকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখা হয়। সেখানে মুজাহিদের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে জানতে পেরে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকসেনারা। প্রায় এক মাস ৩ দিন তাকে সেখানে নির্যাতন করা হয়। এতে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।

ট্রাইব্যুনালের আমৃত্যু কারাদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল যে অভিযোগে:
অভিযোগ- ৫: যুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরোনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করেন।

মামলার বিচারিক কার্যক্রম:
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। ২ আগস্ট ২০১০ তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

১৬ জানুয়ারি ২০১২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ ১০৯ পৃষ্ঠার ৩৪টি বিভিন্ন ঘটনাসহ মোট ছয় হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন।

২৬ জানুয়ারি ২০১২ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল ২০১২ মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়।

২১ জুন ২০১২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়। ৫ মে ২০১৩ মুজাহিদের পক্ষে একমাত্র সাক্ষী হিসেবে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছোট ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর।

ট্রাইব্যুনাল সাফাই সাক্ষীর সংখ্যা ৩ জন নির্ধারণ করে দিলেও আর কোনও সাক্ষী হাজির করতে পারেননি আসামিপক্ষ। ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদের অপরাধ প্রমাণিত স্যাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদের আইনজীবিরা আপিল করে ১১ আগস্ট ২০১৩। আপিলের নিষ্পত্তি হয় ১৬ জুন ২০১৫।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত