নিউজ ডেস্ক

২৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ১০:২২

‘পুলিশ হেফাজতে’ মৃত্যুর তদন্ত করতে চায় পুলিশই, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি অনাস্থা

পুলিশের হাতে কিংবা হেফাজতে কেউ মারা গেলে তার তদন্ত ক্ষমতাও চায় পুলিশ। বিদ্যমান আইনে গুলির ব্যবহারসহ এ ধরনের ঘটনায় তদন্ত করার এখতিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে তা আইনসঙ্গত ছিল কিনা তা তদন্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

তবে পুলিশ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তদন্তের ঘোর বিরোধী। তারা চান, তাদের ঘটনা তারা নিজেরা তদন্ত করবেন। একই সঙ্গে পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশই তার তদন্ত করবে।

বুধবার রাতে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক ও মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মেলনে জোরালভাবে এসব দাবি জানানো হয়। বলা হয়, ‘হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন’ দ্রুত সংস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইনের পরিবর্তে ২০০৭ সালে চূড়ান্ত করা প্রস্তাবিত ‘পুলিশ অধ্যাদেশ’ দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানানো হয়।

‘পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬’ উপলক্ষে বুধবার সন্ধ্যায় প্রথমে আইজিপির উপস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের ক্যাডার কর্মকর্তাদের সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলন শেষে রাত সাড়ে ৮টায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাডার) বার্ষিক বৈঠক শুরু হয়। এ দুটি সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- পুলিশের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত ক্ষমতা প্রত্যাহার করা।

পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আইনশৃংখলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক। সভায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটিও গঠিত হয়। এতে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকে সভাপতি ও গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন উর রশীদকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে এ সভায় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের কয়েকজন জানান, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে তা তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসক বা ডিসির দারস্থ হতে হয়। এরপর ডিসির মনোনীত প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে নির্বাহী তদন্ত করানো হয়। যাকে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত। কিন্তু এতে করে অনেক সময় তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। ঘটনাটি ‘জাস্টিফাইড’ হলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।তাই তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত চান না।

তাদের দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহারের আশংকা করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশের শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ আর চলবে না। এরকম কোনো অভিযোগ উঠলে পুলিশই তার তদন্ত করবে। প্রয়োজনে পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলের মতো আলাদা সেল করে তদন্ত করা যেতে পারে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা অভিমত দেন।

ব্রিটিশ আমলের আইন সংস্কার : সম্মেলনে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মুখলেসুর রহমান বলেন, বিদ্যমান পুলিশ আইন কাজের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ আমল ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংস্কার করার কথা বলেন তিনি। সভায় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালে প্রস্তুত করা প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশে পুলিশ বাহিনীকে অধিকতর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনটি কার্যকর করা হলে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও থাকবে না। অথচ অতি প্রয়োজনীয় আইনটি ২০০৭ সাল থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এটি কেন পাস হচ্ছে না তাও তারা জানেন না।

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আইনে পুলিশকে সেবাদানকারী সংগঠনে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক খবরদারির সুযোগও কমে যাবে। রাজনৈতিক চাপে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত কাউকে দু’বছরের আগে বদলি করা যাবে না। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা যে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোনে সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।

প্রসংগত: দেশের পুলিশ বাহিনী চলছে ১৮৬১ সালের পুরোনো আইন দিয়ে। তাই পুলিশকে যুগোপযোগী করতে একটি নতুন আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৭ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশের সাবেক আইজিপি এএসএম শাহজাহানের নেতৃত্বে একটি কমিটি ওই খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। অধ্যাদেশের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তীতে বিভাগ, জেলা ও উপজেলার তৃণমূল পর্যায় থেকে জনমতও সংগ্রহ করা হয়। সাধারণ মানুষের মতামতের সারসংক্ষেপে বলা হয়, অনেকে পুুলিশ প্রধানের পদটি সাংবিধানিক পদ হওয়া উচিত বলে মনে করেন। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পৃথকভাবে জেলা পুলিশ নিয়োগের জন্য কমিটি গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে। পুলিশ প্রধানের সুপারিশে সরকার জেলা পুলিশ প্রধান নিয়োগ করবে। তবে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত হলে তা করবে পুলিশ কমিশন।

যে দাবিতে এখনও অনড় : পুলিশ সার্ভিস অ্যাসিয়েশনের বৈঠকে আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র পুলিশ বিভাগ গঠনের দাবি জানানো হয়। তারা চান পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও কেনাকাটাসহ সবকিছু এ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে। একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এর কাঠামো হবে অনেকটা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মতো।
অন্যান্য আলোচনা : পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভায় ‘পুলিশ ব্যুরো অব কাউন্টার টেরোরিজম’ (পিবিসিটি) ইউনিট গঠনের জন্য জোর দাবি তোলা হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘ সদর দফতরে পুলিশের জন্য একজন লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। দূতাবাসগুলোতে পুলিশ লিয়াজোঁ অফিসার বা পুলিশ মিনিস্টার পদ দাবি করা হয়। এছাড়া ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ট্রেনিং সেন্টার থেকে দ্রুত তথ্য পাওয়ার বিষয়ে বলা হয়, ই-মেইল করার সঙ্গে সঙ্গেই তারা যাতে কল রেকর্ড পেতে পারে। জেলাপর্যায়ে মোবাইল ট্র্যাকিং সরঞ্জামও চেয়েছেন তারা। থানা ও ফাঁড়ির জন্য খাস জমিও চাওয়া হয়েছে সম্মেলনে। পরিধি বাড়ানো, আবাসন ও গাড়ি সংকট নিরসনসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়।

মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্মেলন : পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আইজিপির সঙ্গে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা চলাকালে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, হাইওয়েতে মোটরসাইকেল নিয়ে কোনো পুলিশ যাতে ডিউটি না করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলা এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা চান তিনি। ভোলা জেলার পুলিশ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সুপার বলেন, এক জেলার পুলিশের রেশন ক্রয় করেন অন্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপাররা। এতে অহেতুক জটিলতা তৈরি হয়। তিনি নিজ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে এ সুযোগ দেয়ার দাবি করেন। পাশাপাশি পুলিশ ছাপাখানা স্থাপনের দাবি জানান। পুলিশ সদর দফতরের একজন ডিআইজি বলেন, থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির জন্য বিনামূল্যে জমি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে খাস জমি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. সাদিকুর রহমান পুলিশ মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি একটি পুলিশ নার্সিং হোম করার বিষয়ে দাবি উত্থাপন করেন।

আইজিপি একেএম শহীদুল হক তার বক্তৃতায় বলেন, পুলিশ বর্তমানে দুটি বড় সমস্য মোকাবেলা করছে। যার একটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ ও অপরটি মাদকদ্রব্য। এজন্য জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় জেলা পর্যায়ে স্পেশাল টাস্ক গ্রুপ (এসটিজি) গঠনের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের জন্য এসটিজি গঠন জরুরি। তিনি বলেন, মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে সচেতন হতে হবে। সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতা বা সম্পৃক্ততার অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন আইজিপি।

আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, জেলাপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের জেলা প্রশাসক, জেলা জজ, থানা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে জেলা ও থানাপর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানো খুব জরুরি। জেলায় ক্রিমিনাল ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। পিবিআইয়ের সঙ্গে কাজের সমন্বয়ও বাড়াতে হবে।
আইজিপি আরও বলেন, পুলিশকে অবশ্যই আইন মেনে চলতে হবে। পর্যবেক্ষণে দেখা দেছে, দায়িত্বপালনকালে সবচাইতে বেশি পুলিশ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় একজন পুলিশ মারা গেলে সেটা পুলিশ বাহিনীর জন্যও লজ্জার বিষয়। তাই আইন না মেনে যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া যাবে না। অপ্রয়োজনে মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে ডিউটি না করার পরামর্শও দেন তিনি।

আচরণগত বিষয়ে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক করেন আইজিপি। তিনি বলেন, পুলিশের কাজ হবে সেবামূলক। কারও সঙ্গে রুঢ়, অপেশাদার আচরণ করা যাবে না। কোনো মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। আইনে সব নাগরিকের সমান অধিকার সেটা নিশ্চিত করতে হবে। হীনমন্যতায় না ভুগে দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করতে হবে। নিপীড়িত নিরীহ মানুষের পক্ষে থাকতে হবে। টেলিভিশন বা টকশোতে কথা বলার আগে আইজিকে অবহিত করতে হবে। সম্মেলনে আইজি বলেন, আপনারা ব্যাংক, বীমা, মেডিকেল কলেজসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব দাবি করেছেন তার সবই পর্যায়ক্রমে পূরণ হবে।

সূত্র : যুগান্তর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত