শাকিলা ববি

১৮ আগস্ট, ২০২২ ১৫:৩৮

চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে ‘বাধা’ মজুরি বোর্ড

২০১০ সালে মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে। প্রতি পাঁচ বছর পর শ্রমিকদের মজুরি নতুন করে নির্ধারণ করার কথা থাকলেও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড তা করেনি। তাই মালিকপক্ষের সাথে প্রতি দুইবছর পর পর চুক্তির মাধ্যমে ৪৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় মজুরি উন্নীত করে চা শ্রমিকরা।

সবশেষ ২০২১ সালের ১৩ জুন দীর্ঘ ১১ বছর পর চা শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গেজেট আকারে খসড়া মজুরির ১২০টাকা সুপারিশ প্রকাশ করে। কিন্তু এর আগেই মালিক ও শ্রমিক পক্ষের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২০টাকা মজুরি কার্যকর হয়েছে। তাই ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিকরা এবং তাদের সংগঠনগুলো এই খসড়ার প্রতিবাদ করে আসছেন ওই সময় থেকেই। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষের। চলতি বছর জুন মাসের শেষ দিকে মজুরি বোর্ডর সর্বশেষ মিটিংয়েও ১২০ টাকা মজুরির সুপারিশ করে মজুরি বোর্ড। মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আগামী ৫ বছর ১২০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে হবে চা শ্রমিকদের।

এদিকে চা শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে শ্রমিকদের দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরি কোনো যুক্তি ছাড়া চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে মজুরি বোর্ড। চা বাগানের মালিকরা যা বলেন মজুরি বোর্ডও সে অনুযায়ী কাজ করে। সরকার যে মজুরি বোর্ড গঠন করছে সেটা মালিক পক্ষের স্বার্থের জন্য কাজ করছে।

চা শ্রমিক নেতারা বলছেন, চা শ্রমিকদের আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী  জীবন ধারণ উপযোগী মজুরি দিতে বাধ্য। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে না।

এই মজুরি বোর্ডের সদস্য বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই মজুরি বোর্ড গঠনের পর অনেকগুলো মিটিং হয়েছে। সেই মিটিংয়ের পর তারা একটি খসড়া দিয়েছিল। এই খসড়া প্রকাশের পর শ্রমিকরা আপত্তি দিয়েছে। এরপরও ১২০ টাকা মজুরির জন্য তারা প্রস্তাব করে। আমিও মজুরি বোর্ডের সদস্য তারপরও আমি বলছি তারা করেছিল কারণ, এই মজুরির এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি একমত না। তাই আমি প্রতিবাদ করে ওই খসড়াতে স্বাক্ষর করিনি। তখন সর্ব সম্মতিক্রমে নয় সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মুজুরিবোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ বৈঠকে আবারও ১২০ টাকা সুপারিশ করে মজুরি বোর্ড। অথচ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২০টাকা মজুরি কার্যকর হয়েছে। এখন ২২ সালের অর্ধের বেশি যাওয়ার পর এখনও আবার তারা বলছেন এই ১২০ টাকাই মজুরি থাকবে। এটা মূলত মালিক পক্ষের যে প্রস্তাব ছিল এই প্রস্তাবটাকে মজুরি বোর্ডে যারা আছেন তারা অগ্রারিধাকার দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করেছে মজুরি পুনঃবিবেচনার জন্য। অথচ এই মজুরি বোর্ড করছে উল্টো। আমার জানা মতে মজুরি বোর্ডের ইতিহাসে এমন দেখিনি যে একটি মজুরি বোর্ড হবে কিন্তু এক টাকাও মজুরি বৃদ্ধি করবে না।

চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে সিলেট বিভাগে। এসব চা বাগানে কাজ করছেন সহস্রাধিক শ্রমিক। শুরু থেকেই এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা বঞ্চিত হয়ে আসছেন। পাওয়ার মধ্যে বাগান থেকে রেশন বলতে শুধু আটা দেওয়া হয়। তাও মাথা পিছু তিন কেজি ৪০০গ্রাম সপ্তাহে একবার। মাটির ঘর, অপুষ্টিকর খাবার, শিক্ষার অভাব, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনসহ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন তারা। নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বমুখী বাজারে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটে তাদের। সিলেটসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা একই ভাবে জীবন যাপন করছেন। তাই ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে গত মঙ্গলবার থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন চা শ্রমিকরা।

চলমান এই আন্দোলনের নেতা সিলেট ভ্যালি সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, খেয়ে যাতে শ্রমিকরা বাঁচতে পারে সেটাই চাচ্ছি আমরা। বর্তমান সময়ে এই মজুরি দিয়ে একজন মানুষ জীবন চালতে পারবে না। নূন্যতম খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্য আমরা এই ৩০০ টাকা মজুরি চাচ্ছি। এই দাবীটা দীর্ঘদিনের। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার বা মালিকপক্ষ স্থায়ী কোনো সমাধান দিচ্ছে না। মালিকপক্ষ অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিচ্ছে ১৪ টাকা বাড়াবে। কিন্তু আমরা মানি নাই।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু মজুরি বোর্ডতো আমাদের মত গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে না। মজুরি বোর্ড কথা বলে যারা ক্ষমতায় আছে, যাদের কোটি টাকা আছে তাদের। চা বাগানের মালিকরা যা বলে মজুরিবোর্ডও তাই বলে। সরকার যে মজুরি বোর্ড গঠন করছে সেটা আমাদের জন্য না মালিক পক্ষের স্বার্থের জন্য। তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাদের এই কর্মসূচি।


চা বাগানের ৭৪% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। এর প্রধান কারণ হল নিম্ন মজুরি। এমনটি উল্লেখ করে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন,  আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুযোগ আছে। ২ বছর পরপর মালিক পক্ষের সাথে চুক্তির প্রথাটাও নষ্ট করে দিচ্ছে মজুরি বোর্ড। ১৯ মাস হয়ে গেছে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও মালিকপক্ষ করছে না। এই সব কিছুর অর্থ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যে মানুষ বাঁচলো কি বাঁচলো না সেটা বিষয় না। মালিক পক্ষ তাদের মুনাফার ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চিত থাকতে চায়। সরকার বা মজুরি বোর্ড আমাদের জন্য যদি কিছু বিবেচনা করবে না, তাহলেতো আমাদেরকে ৪২টি সেক্টরে যে মজুরি বোর্ডের আওতাধিন রাখা হয়েছে সেখান থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত। কিন্তু কোনো কিছুই করা হচ্ছে না। সব দিক দিয়ে আমাদেরকে আটকে রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের মজুরি চা উৎপাদনকারী দেশসমূহের মধ্যে বিশ্বে সর্বনিম্ন। এবং চায়ের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ে। কিন্তু এরপরও মালিকরা ওই একই বিষয়কে সামনে আনার চেষ্টা করে যে, চায়ের দাম কম। তাদের কথা শুনে মজুরি বোর্ড বলে আমরা বিচার বিবেচনা করে দেখেছি ১২০ টাকা মজুরিই ভাল। কোনো যুক্তি ছাড়া মজুরি বোর্ড তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। আমরা মজুরি বোর্ডের কার্যক্রমে হতাশ । তাই আন্দোলন ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। এরকম একটা প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি এখনো সুযোগ আছে এই সিদ্ধান্তটা রিভিউ করানোর। সরকার চাইলে আইনগত ভাবে এখনো সুযোগ আছে চা শ্রমিকদের প্রতি হতে যাওয়া এই অন্যায় রুখে দেওয়ার।  

রামভজন কৈরী বলেন, এখন মালিক পক্ষ আমাদেরকে বলছে, তোমরাতো সরকারের কাছে গিয়েছিলে সরকারতো তোমাদেরকে ১২০ টাকাই দিল। সরকারতো বেশি দেয়নি। এখন আমরা বিবেচনা করে তোমাদেরকে ১৪ টাকা বেশি দিতে চাচ্ছি। এতেই তোমরা খুশি থাকো। এইযে এই মজুরি বোর্ড আমাদেরতো ভাল করেই নাই বরং মালিকদের হাতে একটা হাতিয়ার তুলে দিল। ওরা বলতে পারতেছে সরকার তোমাদের জন্য কিছু করেনি। তিনি বলেন, চা বাগানের মানুষ শান্তি প্রিয় মানুষ। তারা কখনো আন্দোলন বা ঝোট ঝামেলায় যেতে চায় না। কিন্তু যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তখন আন্দোলন ছাড়া আর উপায় থাকে না। চা বাগান মালিকরা আমাদেরকে এভাবে ঠকিয়ে চলছে বছরের পর বছর। তাই আমাদের একটাই ভরসার জায়গা ছিল মজুরি বোর্ড। এর আগের যে মজুরি বোর্ড ছিল সেখান থেকে চা শ্রমিকরা কিছু না কিছু পেয়েছে। কিন্তু এবারের মজুরি বোর্ড যা করেছে তা অবিশ্বাস্য। মজুরি বোর্ড আমাদের সঙ্গে এরকম করবে জানলে আমরা তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতাম না।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডর সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, এই খসড়া মজুরির সুপারিশ এখন মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখানে এটা প্রক্রিয়াধীন আছে। আমার জানামতে এটা আইন মন্ত্রণালয়ে চলে গেছে। কিছু দিনের মধ্যে হয়তো প্রজ্ঞাপন আকারে চলে আসবে।

পাঁচ বছর পর পর এই মজুরি নির্ধারণের কথা থাকলে কেন ১১ বছর পর নতুন মজুরি খসড়া প্রকাশ করলো মজুরি বোর্ড- এই প্রশ্নের জবাবে রাইসা আফরোজ বলেন, সাধারণত ৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরই মজুরি নির্ধারণ হয় শ্রমিক মালিক প্রতিনিধি পাওয়া সাপেক্ষে। কিন্তু এখানে শ্রমিক মালিক পেতে একটু দেড়ি হওয়ায় এই বিলম্ব হয়েছে। এই বিষয়টা শ্রম অধিদপ্তর মেন্টেইন করে।

মালিক পক্ষের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের স্বার্থে মজুরি বোর্ড কাজ করছে, শ্রমিক নেতাদের এই অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধিও আছেন। শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যিনি কথা বলবেন তিনিতো মিটিংয়ে উপস্থিতই থাকেন না। উনাকেতো আসতে হবে। উনি শুধু পিছায়। উনাকে মিটিংয়ে আনা যে কি যুদ্ধ সেটা শুধু ন্যূনতম মজুরি বোর্ডই জানে। উনি শেষ মিটিংয়েও অংশগ্রহণ করেননি। উনার দাবি দাওয়াতো আর আমরা পেশ করবো না। আমরা হচ্ছি সরকার পক্ষ। এখানে মালিক পক্ষ থাকে শ্রমিক পক্ষ থাকে। দেখা যাচ্ছে মালিক পক্ষ দাবি দাওয়া পেশ করতেছে। কিন্তু শ্রমিক পক্ষ কোথায় তাদের দাবি দাওয়া পেশ করার জন্য। দাবি আদায়ের জন্য মিটিংয়ে শ্রমিক পক্ষকেও থাকতে হবে। এই ১২০ টাকা মজুরি পুনঃ বিবেচনার জন্য উনাদের বোর্ডেও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু উনাদেরকেতো আসতে হবে। দাবি দাওয়া পেশ করতে হবে।

তিনি বলেন, চা শ্রমিক প্রতিনিধি যিনি রয়েছেন তিনি বোর্ডেই আসেন না। উনি জুম মিটিং করবেন। নানা অজুহাতে বোর্ডে আসেন না। উনি সব জায়গায় যেতে পারছেন কিন্তু বোর্ডে আসতে পারছেন না। তাহলে শ্রমিকদের কথা বলবে কে। মন্ত্রণালয়ে অনেক কিছু হয়েছে কিন্তু তাকে তো আসতে হবে এবং শ্রমিকদের কথা বলতে হবে। মজুরি নিয়ে এই জটিলতাটা উনারাই তৈরি করছেন। এই ১২০ টাকার সুপারিশ আমরা নতুন করে পাঠাইনি। এটা অনেক আগে পাঠানো হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত