বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি

১৮ আগস্ট, ২০২২ ১৭:০৫

ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ দিবস আজ

আজ ১৮ আগস্ট। ঐতিহাসিক নানকার কৃষক বিদ্রোহ দিবস। ১৯৪৯ সালের এই দিনে সিলেটের বিয়ানীবাজারের সানেশ্বরে নানকার প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত কৃষক ব্রজনাথ দাস, কটুমনি দাস, প্রসন্ন কুমার দাস, পবিত্র কুমার দাস, অমূল্য কুমার দাস ও রজনী দাস জীবন দেন তৎকালীন ইপিআর ও জমিদার বাহিনীর হাতে।

এ হত্যাকান্ডে পর নানকার আন্দোলন অগ্নিস্ফুলিংয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৫০ সালে তৎকালীন সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। পরিসমাপ্তিও ঘটে নানকার বিদ্রোহের। এটি ছিল পাকিস্তান আমলে অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম।

'নানকার' বিদ্রোহ::
নানকার বিদ্রোহের ফলে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, কৃষকরা জমিদারদের খাজনা দেওয়া ও জমিদারদের হাট-বাজারে কেনাকাটা বন্ধ করে দেন। জমিদার বাড়িতে কর্মরত সব দাসী-বাঁদীসহ বেরিয়ে আসেন কাজ থেকে। বিভিন্ন স্থানে জমিদার ও তার লোকজনকে ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জমিদাররা সরকারের দ্বারস্থ হয়। তাদের প্ররোচনায় পাকিস্তান সরকার নানকার বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৯ সালের ১৭ আগস্ট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্রাবণী সংক্রান্তি। উৎসব-আরাধনা শেষে নিজ বাড়িতে অনেকেই ঘুমিয়েছিলেন। ১৮ আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ইপিআর বাহিনী ও জমিদারের লোকজন আক্রমণ করে সানেশ্বরে। হঠাৎ আক্রমণে ঘুম থেকে উঠে মানুষ এদিক-সেদিক পালাতে থাকে। সানেশ্বর গ্রামের লোকজন পালিয়ে পার্শ্ববর্তী উলুউরিতে আশ্রয় নেয়। উলুউরি গ্রামে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন নানকার আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও সুরথ পাল। তাদের নেতৃত্বে উলুউরি ও সানেশ্বর গ্রামের কৃষক নারী-পুরুষ সবাই শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেয় এবং লাঠি, হুজা, ঝাঁটা ইত্যাদি নিয়ে সানেশ্বর ও উলুউরি  গ্রামের মধ্যবর্তী সুনাই নদীর তীরে সরকারি ও জমিদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু ইপিআরের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি কৃষকরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৫ জন। আহত হন হৃদয় রঞ্জন দাস, দীননাথ দাস, অদ্বৈত চরণ দাসসহ অনেকে। বন্দি হন নানকার আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও উলুউরি গ্রামের প্রকাশ চন্দ্র দাস হিরণ, বালা দাস, প্রিয়মণি দাস, প্রহাদ চন্দ্র দাস ও মনা চন্দ্র দাস। এর পর বন্দিদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পালিয়ে যাওয়া কৃষকদের ধরতে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয় সানেশ্বর ও উলুউরি গ্রামে।

যে স্থান থেকে সূত্রপাত হয় নানকার বিদ্রোহের ::
ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার থানা। এ অঞ্চলের নানকার ও কৃষকরা সর্বপ্রথম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাউতা বাহাদুরপুর অঞ্চলের জমিদাররা অতিমাত্রায় অত্যাচার করতেন সাধারণ মানুষের ওপর।

লোকমুখে শোনা যায়, বাহাদুরপুর জমিদার বাড়ির সামনে রাস্তায় স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে হাঁটা যেত না। ছাতা টানিয়ে চলা ও ঘোড়ায় চড়াও ছিল অপরাধ। কেউ এর ব্যতিক্রম করলে পেতে হতো কঠোর শাস্তি। জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও তাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস কারোরই ছিল না। দিনে দিনে জমিদারদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পুঞ্জীভূত হতে থাকে ক্ষোভ। এই অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য গোপনে বৈঠকে বসতেন সাধারণ মানুষ। অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চলতে থাকে নানকার কৃষকসহ সব নির্যাতিত জনগণকে সংগঠিত করার কাজ।

নানকার বিদ্রোহে শহীদ প্রসন্ন কুমার দাসের নাতি বিপ্লব চন্দ্র দাস বলেন, আমরা গর্বিত যে, আমাদের পরিবারের কেউ এই ধরনের সংগ্রাম করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। সানেশ্বর ও উলুউরী গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে সুনাই নদীর তীরে জমি কিনে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় ২০০৯ সালে। প্রতিবছর স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে সম্মান জানানো ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। আমাদের দাবি, নানকার বিদ্রোহ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারিভাবে যেন পালন করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত