০৩ অক্টোবর, ২০২৪ ২১:১৬
ভারতের সীমান্তবর্তী উপজেলা সিলেটের জৈন্তাপুর। এই উপজেলায় উল্লেখ করার মতো পশু পালন করা না হলেও এখানকার হাট-বাজার সবসময়ই গরু-মহিষে থাকে পরিপূর্ণ। আবার এখানে চিনিকল না থাকলেও প্রতিদিন এই উপজেলা থেকে শত শত ট্রাক চিনি সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নানা ব্র্যান্ডের মাদক।
সব কিছু প্রকাশ্যে চললেও প্রশাসন নির্বিকার। সবমিলিয়ে জৈন্তাপুর এখন চোরাচালানের অভয়ারণ্য।
সময় বদলায়, বদলায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট। তবে জৈন্তাপুর সীমান্ত নিয়ে চোরাকারবার বদলাচ্ছে না। দেশ জুড়ে চলছে যৌথবাহীনির তৎপরতা ধরা পরছেন অপরাধীরা। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহীনির চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাচালান অব্যাহত রাখছে।
বিগত কয়েক বছর থেকে চোরাকারবারের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিততি লাভ করেছে। গত ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চোরাচালান বন্ধ না হয়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার সীমান্ত পথগুলো হয়ে উঠেছে চোরাকারবারীদের অন্যতম নিরাপদ রুট।
উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২শটির বেশি পয়েন্ট দিয়ে ব্যাপক হারে ভারতীয় চোরাচালান বানিজ্য চলছে। যদিও উপজেলায় গরু মহিষ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তেমন কোন খামার নেই। কিন্তু উপজেলার প্রতিটি হাঠ-বাজারে ভারতীয় গরু-মহিষে পরিপূর্ণ থাকে। অপরদিকে হাত বাড়ালেই মিলছে নানান ব্যান্ডের মাদক সামগ্রী।
সরজমিনে জৈন্তাপুর উপজেলার নলজুরী খাঁসীনদী, খাঁসী হাওড়, মোকামবাড়ী, আলুবাগান, মোকামপুঞ্জি, শ্রীপুর, আর্দশগ্রাম, মিনাটিলা, কেন্দ্রী মন্দির, কাঠালবাড়ী, কেন্দ্রী হাওড়, ডিবির হাওড়, (আসাম পাড়া), মরিছমারা, ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, গৌরীশংকর, টিপরাখলা, করিমটিলা, কমলাবাড়ী, ভিতরগোল, গোয়াবাড়ী, বাইরাখেল, হর্নি, ময়না, নয়াগ্রাম, জালিয়াখলা, কালিঞ্জি, লালমিয়া ও অভিনাশের টিলা, জঙ্গীবিল, আফিফানগর, তুমইর, বাঘছড়া, বলিদাঁড়া, রাবারবাগন, ইয়াংরাজা এলাকার অন্তত ২শত এর অধিক পয়েন্ট দিয়ে চোরাকারবারী দলের সদস্যরা স্থল ও নৌপথে নিরাপদে চোরাচালান বানিজ্য পরিচালনা করছে। চোরাচালান দলের সদস্যরা ভারত হতে চিনি, নিম্নমানের চা-পাতা, গরু-মহিষ, কসমেট্রিক্স, শাড়ী-লেহেঙ্গা, মাদকজাত পন্য (ফেন্সীড্রিল, কসিড্রিল, ইয়াবা, মদ, বিআর, গাজা, আফিম, হেরোইন) সামগ্রী, ভারতীয় মটরসাইকেল, আমদানী নিষিদ্ধ শেখ নাছির উদ্দিন বিড়ি, হাসপাতালের আপারেশন থিয়েটারের সামগ্রী, ভারতীয় চেতনা নাশক ঔষধ সহ বিভিন্ন কোম্পানীর ঔষধ সামগ্রী, হরলিক্স, শিশুখাদ্য সহ, টাটা গাড়ীর টায়ার টিউব সামগ্রী বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।
চোরাকারবারী দলের সঙ্গে যুক্তরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বে তৎকালীন সরকারের কিছু সংখ্যাক নেতৃবৃন্দ, কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, সীমান্ত বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজেসে মোটা অংঙ্কের চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে চোরাচালান হয়ে আসছিল। সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার শুরু হলে প্রশাসন অভিযান শুরু করে। ব্যাপক চোরাচালান পন্য সিলেট সহ সারাদেশে আটক হয়। ঐসময় চোরাচালান ব্যবসায় কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে।
তারা আরও জানান, জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ও জৈন্তাপুর ইউনিয়নের সীমান্তের পয়েন্টগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা বেশ সুবিধাজনক। ফলে সীমান্ত থেকে সহজে পণ্য পরিবহন করা যায়। আবার নৌপথে পণ্য পরিবহনও সহজ। এ ছাড়া এ পাশটায় ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় চোরাকারবারিদের কাছে বেশ পছন্দের। গরু-মহিষ এই দুই ইউনিয়নের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে বেগ পেতে হয় না। ফলে এই পথ ব্যবহার করে পশু দ্রুত স্থানীয় বাজারগুলোয় নিয়ে যাওয়া যায়। পরে ইজারার ফি দিয়ে গরু-মহিষ বিক্রির রশিদ নিয়ে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য এর জন্য সোর্স ও লাইনম্যানদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। মাঝে মধ্যে বিজিবির অভিযান বা মামলা দেখাতে 'সিজার চুক্তিতে কিছুসংখ্যক গরু-মহিষ আটক করা হয়।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর ১০ আগষ্ট হতে পুনরায় মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে চোরাকারবারি সদস্যরা। এসময়ে পুলিশ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে, ধরপাকড়াও নাই, এই সুযোগে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বিজিবির নাম ব্যবহার করে জৈন্তাপুর সীমান্ত একক অধিপত্য বিস্তার করে বিজিবির সোর্স পরিচয়দানকারি কয়েকজন। সোর্সদের মাধ্যমে ভারতীয় পন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা হয় বলে একাদিক সূত্র জানায়।
তারা আরও জানান, সিলেটের অন্যান্য উপজেলার চাইতে জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়ন ও জৈন্তাপুর ইউনিয়ন সীমান্ত গুলোর প্রতিটি পয়েন্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে ভাল। কারন মূল সড়ক হতে এই দুই সীমান্ত এক কিলোমিটার হতে আধা কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে যেকোন পরিবহনের মাধ্যমে সীমান্ত হতে পণ্য সহজে পরিবহন করা যায়। এছাড়া নৌকা যোগে সীমান্ত হতে পন্য প্রবেশ করে নিরাপদে নিয়ে যাওয়া যায়। ভারত সীমান্তে নেই কাটা তারের বেড়া। যার কারনে চোরাকারবারীদের নিকট জৈন্তাপুর সীমান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
গরু-মহিষ প্রবেশেও নেই তেমন কোন কষ্ট। কারন সীমান্তের পথ ব্যবহার করে দ্রুত স্থানীয় বাজার গুলোতে প্রবেশ করানো সহজ। পরবর্তীতে ইজারাদার কর্তৃক ফি দিয়ে গরু মহিষ বিক্রয়ের রশিদ সংগ্রহ করে গাড়ী যোগে দেশের বিভিন্ন হাট বাজারে প্রেরণ করা হয়।
বিজিবির সোর্স বা লাইনম্যানগন মোটা অংকের টাকা নিয়ে সীমান্ত ক্রসের সুযোগ তৈরী করে দেন। এসময় বিজিবির অভিযান বা মামলা দেখানোর জন্য সীজার চুক্তির জন্য কিছু সংখ্যক গরু মহিষ বিজিবিকে দেন। বিজিবি আভিযানে আটক দেখানো হয়। এভাবে সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত হয়ে উঠেছে চোরাচারানের নিরাপদ রুট হিসাবে।
বর্তমানে চোরাচালানে নতুন নেতেত্বে চলছে বানিজ্য। জৈন্তাপুর সীমান্তে সবচেয়ে বেশি চোরাচালান পন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ৪৮ বিজিবির ডিবিরহাওড়, ১৯ বিজিবির ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, গৌরীশংকর, টিপরাখলা, কমরাবাড়ী, করিমটিলা, ভিতরগোল, গোযাবাড়ী ও বাইরাখেল সীমান্ত দিয়ে।
সীমান্তের চোরাচালান বিষয়ে জৈন্তাপুর থানার ওসি আবুল বাশার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, 'এখানে আমি কাজে যোগ দিয়েছি সম্প্রতি। আমি চেষ্টা করছি। এর মধ্যে চারটি চোরাচালানের মামলা হয়েছে। আমি আমার মতো করে চোরাচালান ঠেকানোর চেষ্টা করছি।'
এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমানের বলেন, আমরা চোরাচালন বন্ধে জির টলারেন্সে নিয়ে কাজ করছি। সোমবার অভিযান চালিয়ে ভারতীয় চোরাই চিনি ৪৫,৫৫০ কেজি, চা পাতা ১,৫৪৮ কেজি যার বর্তমান বাজার মূল্য ৭৪,৬১,৩০০ টাকার পণ্য আটক করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আপনার মন্তব্য