শাকিলা ববি

০৫ অক্টোবর, ২০২৪ ২১:২৫

জাফলংয়ে পাথর লুটের হিড়িক

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের বল্লাঘাট থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত এলাকার পিয়াইন নদ থেকে শতাধিক বারকি নৌকায় প্রকাশ্যে তোলা হচ্ছে পাথর। যে যার যার মত করে পাথর তোলছেন। এ জায়গা থেকে পাথর তোলা নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

কেন পাথর তুলছেন জিজ্ঞেস করতেই কয়েকজন শ্রমিক বলে উঠলেন, ‘এই পাথর জনগণের সম্পত্তি। আগের সরকার পাথর তোলা বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু ওই সরকার শেষ হওয়ার পর ৫ আগস্ট রাতেই জনগণ এখানে জমা পাথর নিয়ে গেছে। এই পাথর ভারত থেকে আসে আমাদের এলাকায়। তাই এই পাথরে মালিক আমরা। জিরো পয়েন্টে কিছু পর্যটক আসে তাদের জন্য কিছু পাথর রেখে বাকীটা জনগণ নিয়ে যাবে। এখানে কেউ বাধা দিলে আমরা বাধা মানবো না।’

গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে জাফলংয়ের পাথরখেকোদের লুটপাট বেড়ে গেছে। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের স্থবিরতা পাথর তোলার হিড়িক পড়েছে প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলংয়ে। নদীর তলদেশ ছাড়াও নদীর পাড় কেটে তোলা হচ্ছে পাথর এবং বালু। যে হারে পিয়াইন নদ থেকে বালু ও পাথর তোলা হচ্ছে তাতে এই প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা আরও সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

এছাড়া অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকালে টিলা ধসে কিংবা গর্তখননকালে মাটি ও পাথরচাপায় মৃত্যুর ঘটনা আবারও বাড়বে বলে মনে করছেন পরিবেশবিধরা।

একসময় সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র বলতেই ছিল জাফলং। ভারতের ডাউকি নদী ও বাংলাদেশের পিয়াইন নদের মিলনস্থল জিরো পয়েন্টে গিয়ে প্রকৃতি প্রেমীরা উপভোগ করেন জল পাথর আর পাহাড়ের সৌন্দর্য। ভারতের ডাউকি নদী থেকে প্রতিনিয়ত পাথর আসে পিয়াইন নদে। তাই পর্যটনের পাশাপাশি জাফলং ও তার আশপাশের এলাকায় ভারত পাথরের ব্যবসা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এক সময় এই এলাকার মানুষ নিজেদের বাড়ির আঙিনা গর্ত করেও পাথর তুলে বিক্রি করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে জাফলংয়ে পাথর তোলার শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের একটি বড় সিন্ডিকেট তৈরি হয় এবং যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। জাফলংয়ের বুক চিরে সৃষ্টি করা হয় হাজারো পাথর কোয়ারি। এরপরই জাফলং প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পরে।

জাফলংকে ইসিএ ঘোষণা ও বর্তমান চিত্র
২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের রায়ে জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পাথর উত্তোলন কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ইসিএ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে বলা হয়েছে। এরপর জাফলংয়ে প্রকাশ্যে পাথর তোলা বন্ধ হলেও গোপনে ছোট আকারে পাথর তোলা চালু রাখের পাথরখেকুরা। তবে প্রশাসনে অভিযানে একসময় পাথর তোলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্রাণ ফিরে পায় জাফলং।

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের দিন থেকে আবারও পাথর তোলার হিড়িক পড়েছে জাফলংয়ে। শুধুযে পাথর তোলা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। অপরিকল্পিত ভাবে পাথরের পাশাপাশি নদীর পাড় কেটে বালুও তোলা হচ্ছে। যেসব জায়গা থেকে পাথর ও বালু তোলা হচ্ছে সেখানে কাউকে ছবি পর্যন্ত তুলতে দেওয়া হয় না। ছবি বা ভিডিও করতে গেলে সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা বাধা দেন। উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে বালু পাথর তোলা চলমান থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন এসব বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।


পাথর কোয়ারি খোলার দাবিতে বেড়েছে তৎপরতা
বিগত সরকারের পক্ষ থেকে পাথর তোলা বন্ধে কঠোরতা বাড়লেও পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবি তৎপর ছিল পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রমিকরা। তখন ছোটখাটো মানববন্ধন করে স্মারকলিপি দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করলেও বর্তমানে ক্ষমতার হাতবদলে পাথরখেকুদের তৎপরতা অনেক বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে ঘন ঘন বিভিন্ন কর্মসূচি করছেন।

গত ৮ সেপ্টেম্বর সিলেট প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সিলেটে বন্ধ থাকার পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবি জানান বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ। একই দাবিতে ১৯ সেপ্টেম্বর যুব জমিয়ত বাংলাদেশ গোয়াইনঘাট উপজেলা শাখার নেতৃবৃন্দ মানববন্ধন করেন। এমনকি কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবিতে গণসমাবেশ করতে জাফলং গোয়াইনঘাটসহ আশপাশের এলাকায় মাইকিং পর্যন্ত করানো হচ্ছে।

কোয়ারি খোলার দাবি আদায়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন
পাথর কোয়ারি খোলার দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদান করে কোনো কাজ না হওয়ায় এবার ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে পাথরেখেকুরা। বর্তমানে ধর্মীয় বক্তাদের তৎপরতা বাড়ায় ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হয়েছে পাথরখেকুরা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির ও শায়খে চরমোনাই মুফতি ফয়জুল করীমের সাথে মতবিনিময় করেন পাথর ব্যবসায়ী মালিক সমিতির প্রতিনিধিদল।

এরপর গত ১ অক্টোবর বিকেলে সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজার সিটি পয়েন্টে ইসলামি আন্দোলনের  সিলেট জেলা ও মহানগরের উদ্যোগে গণ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুফতি ফয়জুল করীম পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবী জানিয়ে বলেন, পরিবেশের দোহাই দিয়ে যারা পাথর উত্তোলন বন্ধ করেছে তারা বাংলাদেশের আদর্শ লালন করে না। সিলেটের পাথর উত্তোলন বন্ধকারীরা দেশপ্রেমিক নয়। দ্রুত পাথর কোয়ারি খুলে দিতে হবে।

শ্রমিকের মৃত্যু
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা)তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় পাথর উত্তোলন দুর্ঘটনা ঘটলে বেলার পক্ষ থেকে  সরেজমিন পরিদর্শন, এলাকার বাসিন্দা, সংশ্লিষ্ট স্থানে পাথর উত্তোলন কাজে নিয়োজিত শ্রমিক, আহত শ্রমিক ও নিহতের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট থানা ও উপজেলা প্রশাসন ও সিলেট জেলা প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

সেসব তথ্য অনুযায়ী  গত ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরফিন টিলা, উৎমাছড়া, ভোলাগঞ্জ এলাকায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ও বিছনাকান্দি এলাকায়, কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া ও বাংলাটিলা এলাকায় এবং জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে পাথর উত্তোলনকালে ১০৬ জন নিহত হন এবং আহত হন ৩৮ জন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেটের পর্যবেক্ষণ
সম্প্রতি জাফলং এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেটের টিম। পরিদর্শনকালে পাথর তোলার শ্রমিক ও স্থানীয়দের সাথে তারা কথা বলেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার খবরের কাগজকে বলেন, ২০২০ সাল থেকে পাথর তোলা বন্ধ হয়। পাথর তোলা বন্ধ থাকায় শব্দ দূষণ নেই। একটু একটু  করে জাফলং এর প্রকৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর জাফলংয়ে আবারও পাথর উত্তোলন শুরু  হয়েছ। এখনই যদি এই পাথর তোলা বন্ধ করা না যায় তাহলে পরিবেশের ক্ষতির ষোলকলা পূর্ণ হবে। সে আগের মতোই প্রাণহানি ঘটবে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বেলার রিটের পর জাফলংকে ইসিএ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ইসিএ বাস্তবায়ন প্রশাসন দেরিতে হলেও কিছুটা করেছে। কিন্তু এখন যদি পাথর উত্তোলন বন্ধ করা না হয় তাহলেতো প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা কার্যকর হচ্ছে না।

পাথরখেকোদের বড় সিন্ডিকেট নিয়ে তিনি বলেন, জাফলংয়ে পাথরখেকুদের সিন্ডিকেট সব সময় ছিলো। সত্যি বলতে কী এটা আটকানো প্রশাসনের জন্য কোনো কষ্টকর বিষয় বলে আমি মনে করি না। কারণ সরকারের প্রতিনিধিত্ব যারা করছেন তারা যোগ্য এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। তারা জানেন আদালতের রায়ের পরিপন্থী একটি কাজ চলতে দেয়া আদালতের অবমাননা। পাশাপাশি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সভা সমাবেশ করাও আদালত অবমাননার শামিল। তাই জাফলংকে রক্ষায় নীতি নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রশাসনের বক্তব্য
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জাফলং এলাকায় বালু ও পাথর উত্তোলন এবং বিপণন রোধে ‘সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড’ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া জাফলং ডাউকি-পিয়াইন নদীর পাশ দিয়ে বালু-পাথর পরিবহন কাজে নিয়োজিত যানবাহন ( পে-লোডার ও ড্রাম ট্রাক)  যাতায়াত রোধে বল্লাঘাট মসজিদের নীচে রাস্তার দুই দিকে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। স্থায়ী মজবুত ব্যারিকেড ( কনক্রিট পিলার এবং আয়রন পোল) স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিজিবি ও পুলিশের সহায়তায় জাফলং ইসিএ ভুক্ত এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম সার্বিক নজরদারি করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চলতি বছর জুলাই মাসে জাফলং জিরো পয়েন্ট এলাকাসহ ইসিএ ভুক্ত এলাকায় বালু-পাথর উত্তোলন প্রতিরোধ কার্যক্রম মনিটরিং এর জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছিলো। এটি জাফলং ইসিএ এলাকা মনিটরিংয়ে সহায়ক ছিলো। সিসিটিভি সিস্টেম বিগত ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর বিজিবি-পুলিশের শুন্যতায় স্থানীয় দুষ্কৃতকারী পাথর লুট চক্র বিনষ্ট করে ফেলেছিলো। সিসিটিভি সিস্টেমটি পুনরায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, গোয়াইনঘাট এর উদ্যোগে সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অচিরেই পুরো ইসিএভুক্ত এলাকা সিসিটিভি মনিটরিং সিস্টেম (নাইট ভিশন) এর আওতায় পুনঃবাস্তবায়িত হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত