১৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১৫:০৬
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় অবৈধভাবে বিভিন্ন মহাল হইতে বালু উত্তোলন, শ্রীপুর, রাংপানি নদীসহ বিভিন্ন স্থান হইতে পাথর উত্তোলন এবং সীমান্ত চোরাচালানের কোন পরিবর্তন হয়নি। এই সুযোগে সীমান্ত এলাকাসহ বালু ও পাথর কোয়ারিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য চাঁদাবাজ চক্র। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে ঐ চক্র অবৈধ কারবারিদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
সরকার পরিবর্তনের পর জৈন্তাপুরের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল এবার হয়তো চোরাকারবারি, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটবে। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর কিছু দিন মানুষ একটু স্বস্তিতে ছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেত নতুন ভাবে কিছু চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের আবির্ভাব ঘটে। পূর্বের চাঁদাবাজরাও যুক্ত হয় নতুনদের সাথে, পরিবর্তন হয় শুধু নেতৃত্বের। জৈন্তাপুর জুড়ে নতুন চক্র চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে মেতে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় ছাড়াও অনেক সংগঠন বিভিন্ন কৌশলে নানান অপকর্মের সাথে যুক্ত হচ্ছে।
জৈন্তাপুর উপজেলায় অবৈধভাবে বিভিন্ন বালুমহাল ও পাথর কোয়ারি থেকে সিন্ডিকেট চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জৈন্তাপুর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না স্থানীয় গ্রামবাসী। বিভিন্ন সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে কতিপয় নেতাকর্মী বালুমহাল, পাথর কোয়ারিতে সক্রিয় আছে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাঁদা উত্তোলনের কথা প্রকাশ পেলেও ভয়ে মুখ খুলতে চায় না কেউ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদাবাজদের সবচেয়ে বড় টার্গেট পয়েন্ট হচ্ছে বালুমহাল, পাথর কোয়ারি ও গরু মহিষের হাট। সপ্তাহে ২ দিন হাট বসার কথা থাকলেও অবৈধ পথে ভারত থেকে আসা গরু মহিষের বৈধতা দিতে প্রতিদিন বসে গরু মহিষের হাট। বাজার ইজারাদারদের দেওয়া ছাড়পত্রে চোরাই অবৈধ গরু-মহিষ হয়ে যায় বৈধ। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে চাঁদাবাজ ও দখলবাজরা হয়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক অথচ এদের কোন বৈধ ব্যবসা নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান করলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদেরও রাজনৈতিক পরিচয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। এদিকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়ে আপাতত তেমন কাজ হচ্ছে না বলে ভুক্তভোগী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জৈন্তাপুর সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার ভারতীয় মোবাইল ফোন, কিট, গরু-মহিষ, চিনি, কসমেটিক্স, শাড়ি, লেহেঙ্গা, মদ, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সুপারি, কম্বল বিভিন্ন ব্যান্ডের মাদকসহ নানা অবৈধ দ্রব্য ও নেশা জাতীয় ঔষধ সামগ্রী, মোটরসাইকেল, হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জাম চোরাইপথে নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। চোরাচালান পণ্যগুলো নির্বিঘ্নে ভারত থেকে আনতে সহযোগিতা করছে কিছু অসাধু ব্যক্তি। তারা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলের নাম ভাঙিয়ে আদায় করছে চাঁদা। এসব চোরাকারবারিদের সহযোগী চাঁদাবাজরা নাম ভাঙিয়ে রুবেল, করিম, সেলিম, আব্দুস শহীদ, মনছুর, নাজিমসহ স্থানীয় দলীয় কিছু নেতার নামে চাঁদা উত্তোলন করে আসছে। পরে উত্তোলন কৃত টাকা বণ্টন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার নামে।
স্থানীয় বালু মহাল সারী-৩ মামলা ভুক্ত হওয়ায় ইজারা দিতে পারেনি সরকার। এই সুযোগে দলীয় প্রভাব ও ইউনিয়ন ট্যাক্সের নামে শ্রমিকদের কাছ থেকে নৌকা প্রতি ৮শ’ হতে ১ হাজার টাকা উত্তোলন করছে একটি চক্র। অন্যদিকে শ্রীপুর, রাংপানি, পাথর কোয়ারি সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে, কিন্তু বন্ধ কোয়ারি থেকে একেক সময় একেকটি চক্র প্রশাসন, স্থানীয় নেতাকর্মী ও নামধারী কিছু সাংবাদিককে ম্যানেজ করে চলছে অবৈধ পাথর হরিলুট।
সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বালু ও পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বন্ধ হয়নি বালু ও পাথর আহরণ। সীমান্তে জিরো লাইন হতে এবং জিরো লাইন অতিক্রম করেও অনেক সময় পাথর উত্তোলন করা হয়। এতে কোন কোন সময় ভারতীয় বিএসএফএর সাথে ঘটে ঝামেলা। এতে করে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। সেখান থেকে জব্বার বাহিনী নৌকা প্রতি ৯শ’ টাকা চাঁদা আদায় করছে।
এদিকে বন্ধ শ্রীপুর পাথর কোয়ারিতে দেখা গেছে, কয়েক শত শ্রমিক দিনে দুপুরে সীমান্তের ১২৮০ নম্বর আন্তর্জাতিক পিলার এলাকা থেকে দেদারছে পাথর উত্তোলন করছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এসব পাথর নিয়ে যাওয়া হয় আদর্শগ্রাম ও ৪নং বাংলাবাজার ঘাটে। বালু-পাথর উত্তোলনকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল এলাকায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন ১০ জন। এই বিষয়ে একাধিক অভিযোগ হলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
চাঁদাবাজ উল্লেখ করে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়; এতে অভিযুক্তরা হলেন ইন্তাজ আলী, আব্দুল মান্নান, রহিম উদ্দিন, রহমান আলী, তাজ উদ্দিন, মিজানুর রহমান, সামছুজ্জামান সেলিম, হারুন আহমদ, আহসান উল্লাহ, শুয়াইবুর রহমানসহ তাদের বাহিনী। এরা বন্ধ বালু মহাল থেকে অবৈধ ভাবে চাঁদা উত্তোলন করছেন। শ্রমিকরা বলেন, পেটের দায়ে কোয়ারিতে পাথর ও বালু মহাল থেকে বালু উত্তোলন করি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও একজন বলেন, বন্ধ থাকা শ্রীপুর পাথর কোয়ারি থেকে প্রভাবশালী একটি চক্র সীমান্তের ১২৮০ মেইন পিলার এর ৪ এস পিলার এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন করে। সীমান্তে পাথর উত্তোলনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাধা দিলেও তারা পাথর উত্তোলন করে নিয়ে আসছে। এর ফলে যে কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
স্থানীয় ইউপি এক সদস্য বলেন, শ্রীপুর পাথর কোয়ারি সরকারিভাবে বন্ধ। কিন্তু গত দুই বছর হতে একটি প্রভাবশালী চক্র সীমান্তে জিরো লাইন হতে এবং জিরো লাইন অতিক্রম করে পাথর উত্তোলন করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাথর উত্তোলনকারী একাধিক শ্রমিক বলেন, এভাবে চুরি করে আমরা কাজ করতে চাই না, যদি সরকারি ভাবে পাথর উত্তোলন করার সুযোগ তৈরি করা হতো তাহলে উপজেলার ৩০ হাজারের অধিক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু যে হারে বন্ধ কোয়ারি হতে পাথর উত্তোলন হচ্ছে থাতে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। একই সাথে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সূত্র মতে, পাথর ক্রয় ও বিক্রয়কালে নৌকাপ্রতি ‘লাইনম্যান’ ৯শত টাকা চাঁদা আদায় করেন। ব্যবসায়ীদের দাবী, তাদের নামে কিছু লোক বালু পাথরসহ চোরাচালানের বিভিন্ন চালান নিয়ে যেতেন। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে নিয়মিত মহড়াও দিচ্ছেন।
জৈন্তাপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার মো. বদরুজ্জামান বলেন, আমি জৈন্তাপুর থানায় নতুন এসেছি। চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, কোয়ারির বিষয় আমার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।
এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে শালিক রুমাইয়া বলেন, চোরাচালান, বালু মহাল ও পাথর কোয়ারির বিষয়ে অনেক অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। দেশে নতুন সরকার আসার পর পুলিশ অনেকদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, বর্তমানে তারা সক্রিয় আছে। এখন বর্তমানে দুর্গাপূজার কারণে প্রশাসন ব্যস্ত আছে। তবে চোরাচালান, কোয়ারি, চাঁদাবাজি বন্ধে আমারা কাজ করে যাচ্ছি। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
আপনার মন্তব্য