রিপন দে

০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৫:১০

মাত্র ৫ হাজারে বিক্রি হয় বাংলাদেশের শেষ গণ্ডার

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে গণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে বুনো পরিবেশে পাঁচ প্রজাতির গণ্ডার বাস করে। যার দুটি ছিল আফ্রিকায় ও তিনটি ছিল এশিয়ায়। এশিয়ার তিনটি গণ্ডার প্রজাতির সবই ছিল আমাদের দেশে। কালের বিবর্তনে বসতি হারিয়ে, শিকার হয়ে আমাদের দেশের সব গণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

অতীত নথিপত্র, জেলাভিত্তিক গেজেটিয়ার, ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ কর্তৃক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তরে তিস্তা অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তিন প্রজাতির গণ্ডারের বসতি। সর্বশেষ জীবিত গণ্ডারটিকে অর্থের লোভে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পাঁচ হাজার ডলারে লন্ডন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয় ১৮৭২ সালে।

গণ্ডার (Rhinoceros বা Rhino) একপ্রকার স্তন্যপায়ী তৃণভোজী প্রাণী। এটি রাইনোসেরোটিডি পরিবারের অন্তর্গত। বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত এই তিন প্রজাতির গণ্ডারের বসতির বিস্তৃতি ছিল যথাক্রমে: Indian rhinoceros (Rhinoceros unicornis) একশিঙ্গি বড় গণ্ডার নেপাল, সিকিম থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত; Javan rhinoceros (Sunda rhinoceros) সুন্দরবন, যশোর থেকে বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত; Sumatran(Didermoceros sumatrensis) দুই শিঙ্গি গণ্ডারের আবাস কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ছিল।

সুন্দরবন ও যশোর থেকে শিকার করা ১১টি একশিঙ্গি ছোট গণ্ডার কলকাতা, বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে তৎকালীন সময় নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা গেছে।

সুন্দরবনে আদি সভ্যতার প্রত্নস্থলের আবিষ্কারক ইসমে আজম (ঋজু) বাংলাদেশ থেকে গণ্ডারের বিলুপ্তি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

ইসমে আজম (ঋজু) জানান, ১৮৭৬ সালে কুমিল্লায় একটি দুই শিঙ্গি গণ্ডার গুলি করে মারা হয় এবং ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে একটি দুই শিঙ্গি গণ্ডার ধরা হয়। যেটি ছিল বাংলাদেশের শেষ জীবিত গণ্ডার ‘বেগম’। ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের দক্ষিণের কোনো এক স্থানে এটি মানুষের হাতে বন্দী হয়। চোরাবালিতে আটকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল গণ্ডারটি। স্থানীয় লোকজন গণ্ডারটিকে চোরাবালি থেকে তুলে আটকে রেখে প্রশাসনকে জানায়। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ক্যাপ্টেন হুড ও মি. উইকস আটটি হাতি নিয়ে ১৬ ঘণ্টা কঠোর চেষ্টার পর এটিকে বন্দী করেন। অর্থের লোভ সামলাতে পারেনি তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তা। ১৮৭২ সালে বাংলাদেশের জীবিত শেষ গণ্ডারটিকে পাঁচ হাজার ডলারে লন্ডন চিড়িয়াখানার কাছে বিক্রি করে দেন। নিজ বসতভিটা ছেড়ে 'বেগম' বন্দী হলো লন্ডনের খাঁচায়। এই গণ্ডারের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের গণ্ডার প্রজাতি।

লন্ডন চিড়িয়াখানাতেই গণ্ডারটির নামকরণ করা হয় ‘বেগম’ নামে। লন্ডনে মি. কিউলমান নামের এক চিত্রশিল্পী বাংলাদেশের জীবিত শেষ গণ্ডারের ছবিও আঁকেন।

ইসমে আজম আরও জানান, সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০০ সালের শেষ দিকে বা ১৯০০ সালের প্রথম দিকে সুন্দরবনের নলিয়ান থেকে কালাচাঁদ নামের এক শিকারি একটি গণ্ডার Javan rhinoceros (Sunda rhinoceros) শিকার করেন। খুলনার রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায় চৌধুরী শেষ ১৮৮৫ সালে সুন্দরবনে গণ্ডারের পায়ের চিহ্ন দেখেছিলেন। তারপর সুন্দরবনে বা বাংলাদেশের কোথাও গণ্ডারের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সুবাদে সমগ্র সুন্দরবন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫–১৬ সালে বাঘ বিষয়ক একটি গবেষণা কার্যক্রমের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়। মাঠপর্যায়ের সেই গবেষণাকালে আমার দলের নাম দিয়েছিলাম টিম রাইন (গণ্ডারের দল)। বনভূমি ও ইতিহাস অনুসন্ধান করে বুঝেছিলাম সুন্দরবনে তৃণাঞ্চলের ঘাটতি ও অবাধ শিকারই গণ্ডার বিলুপ্তির কারণ।

ইসমে আজম জানান, একসময় সুন্দরবনে চামড়া, শিং ও মাংসের জন্য ব্যাপক আকারে গণ্ডার শিকার করা হতো। প্রাচীনকালে সুন্দরবন অঞ্চলের আদিবাসীরা গণ্ডারের মাংস খেত। সুন্দরবনের প্রাচীন প্রত্নস্থলে তারই নমুনাস্বরূপ একটি গণ্ডারের দাঁতের জীবাশ্ম-প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি অবশ্য অন্যান্য প্রাণির হাড়ের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অন্য আরেক প্রত্নস্থলে পাওয়া যায় পায়ের হাড়, যা দেখে অনুমান করা যায় হাড়ের ভেতরের মজ্জা বের করার জন্য ভাঙা হয়েছিল হাড়টি।

তিনি আরও জানান, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সেকেন্দার ডাক্তার একটি পুকুর খননের সময় মাটির গভীরে দুটি গণ্ডারের কঙ্কাল পান। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন হরিণগড় গ্রামে এফাজতুল্লা সরদার পুকুর খননের সময় একটি গণ্ডারের কঙ্কাল, ধুমঘাট দিঘি খননের সময় ছয়টি গণ্ডারের কঙ্কাল ও ঈশ্বরীপুর মাখন লাল অধিকারীর বাড়িতে ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক এ এফ এম আবদুল জলিল ছয়টি গণ্ডারের কঙ্কাল দেখেন।

ইসমে আজম বলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসরত ঢালী পদবীর লোকজন সুন্দরবনে গণ্ডার শিকার করে তার চামড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য ঢাল প্রস্তুত করত। ঢাল থেকে পেশাগত কারণে ঢালী পদবির উৎপত্তি। এই ঢালীরা মহারাজ প্রতাপাদিত্যের হয়ে যুদ্ধ করত। পরবর্তী যুগে এসে ইংরেজ শিকারিদের ব্যাপক শিকারের ফলে অবশিষ্ট গণ্ডার সুন্দরবন থেকে বিলীন হয়ে যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত