০৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০৫
৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ্মীপুর জেলা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামসদের লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত। ১৯৭১ সালের এ দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে এ জেলায় পাক-হানাদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। যুদ্ধের মহাসংকট থেকে মুক্ত হয় জেলাবাসী।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯টি সম্মুখ যুদ্ধসহ ২৯টি দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। যুদ্ধে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন। খবর বাসসের।
পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রথম জেলা শহরের মাদাম ব্রিজ বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। আজও এর স্মৃতি হিসেবে পুরাতন ব্রিজটির লোহার পিলার দাঁড়িয়ে আছে।
৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন এ জেলায় উল্লেখযোগ্য রণক্ষেত্র গুলো হল- কাজির দিঘীর পাড়, মিরগঞ্জ, চৌধুরী বাজার, দালাল বাজার, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, বাসু বাজার, ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, চর আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রামগঞ্জ হাই স্কুল, রামগঞ্জের গোডাউন এলাকা।
এ সব যুদ্ধে আবু ছায়েম, সৈয়দ আবদুল হালিম বাসু, রবিন্দ্র কুমার সাহা, মাজহারুল মনির সবুজ, মুনছুর আহম্মদ, চাঁদ মিয়া, মো. মোস্তফা মিয়া, জয়নাল আবদিনসহ ৩৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ হাজার হাজার নিরীহ মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩ জন, রামগতিতে ২জন, কমলনগর ১জন, রায়পুরে ৭জন ও রামগঞ্জে ২জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জেলার বিভিন্ন স্থানে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প ছিল জেলা শহরের বাগবাড়ি এলাকায়। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষদের তুলে এনে এ ক্যাম্পে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালাত। এখানেই অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষ গুলোকে হত্যা করে রহমতখালী খালে ভাসিয়ে দিত, আবার গর্ত করে মাটিতেও পুতে ফেলত। যার প্রমাণ জেলা শহরের বাগবাড়িস্থ গণকবর।
১৯৭১ সালের ২১ মে গভীর রাতে লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর ও দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের হিন্দু পাড়ায় পাক-হানাদার বাহিনী ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চালায়। বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে, বহু মানুষকে গুলি ও রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এ সময় ১১টি বাড়ির ২৯টি বসতঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে আগুনে দগ্ধ হয়ে ও হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় ৪০জন নিরস্ত্র বাঙ্গালী। এ সব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের আজও নীরব সাক্ষী হয়ে আছে শহরের বাগবাড়িস্থ গণকবর, মাদাম ব্রিজ বধ্যভূমি, পিয়ারাপুর ব্রিজ ও মজুপুরের কয়েকটি হিন্দু ও মুসলমান বাড়ি।
একাত্তরের ১ ডিসেম্বর প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরী এবং সুবেদার আব্দুল মতিন, আ ও ম শফিক উল্যা, হামদে রাব্বীর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অনেকে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হুমায়ুন কবির তোফায়েল বলেন, পাক হানাদার বাহিনীর গতিরোধ করতে জেলা শহরের মাদাম ব্রিজটি বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে পাক-বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের অসংখ্য নর-নারী হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। সেই স্মৃতি আজও আমাদেরকে কাঁদায়।
উল্লেখ্য, ৪ ডিসেম্বর ‘লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস’ উপলক্ষে প্রতি বছর শহীদদের কবর জিয়ারত, দোয়া-মুনাজাত, আলোচনা সভা ও গণকবরে পুষ্প স্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।
আপনার মন্তব্য