সিলেটটুডে ডেস্ক

৩০ জুন, ২০২০ ১৮:৪৪

‘মীনা কার্টুনের টিয়া পাখি দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে সরিয়ে অন্য কাউকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। এক্ষেত্রে সাবেক কৃষি মন্ত্রীকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে বিএনপি’র সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।

আজ মঙ্গলবার (৩০ জুন) দুপুরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে ২০২০-২১ অর্থ-বছরের বাজেটের ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাকালে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, পীর ফজলুর রহমান, মুজিবুর রহমান (চুন্নু) ও রওশন আরা মান্নান এবং বিএনপির মো. হারুনুর রশীদ।

ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে ‘সব কিছু প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয় মন্তব্য’ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সব কিছু যদি প্রধানমন্ত্রীরই করতে হয় তাহলে মন্ত্রণালয়-অধিদফর এত রাখার তো দরকার নেই। এত টাকা খরচ করে লাভ কী? আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাই অনুসরণ করবো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। দেখা যায় অধিদফতরের সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেনও না।’ তিনি করোনা মোকাবেলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করে কভিড ও ননকভিড দুটো সেকশনে আলাদা করে ফেলার প্রস্তাব দেন।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সেবা দেয়া অসম্ভব। চিকিৎসা সেবা সম্পর্কিত সেক্টরগুলোতে ননডাক্তারদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মেডিকেল সেক্টরের প্রশাসন থেকে শুরু করে সব কিছু ডাক্তারদের হাতে রাখা দরকার। আমাদের দেশে হেলথ ডাটাবেজ নেই। এরা জরুরি।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, সুচিকিৎসার পূর্বশর্ত হলো সঠিক রোগ নির্ণয়। আমাদের জেলা উপজেলায় হাসপাতালে অবকাঠামো আছে কিন্তু টেকনোলজিস্ট সঙ্কটে পরীক্ষাগুলো হয় না। আমাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতমুখী হয়ে গেছে। এই চিৎিসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জনবল সঙ্কট নিরসণ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন



তিনি বলেন, করোনায় সারা বিশ্বে মানুষ মারা যাচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমরা করোনা রোগীকে কতটুকু চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছি সেটা দেখতে হবে। আমি মনে করি বাংলাদেশে আক্রান্তের হার সব থেকে বেশি। প্রতিদিন যে পরীক্ষা হচ্ছে তার ২৩ শতাংশ পজিটিভ আসছে। আর ১০/১৫ দিন পর পরীক্ষার ফলাফল পাচ্ছি। যার কারণে সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা রয়েছে অভিযোগ করে তা সংস্কার করার প্রস্তাব করেন হারুন।

পীর ফজলুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডাক্তারদের খাবার বিল নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। সেখানে একটি কলার দাম দুই হাজার টাকা, একটি ডিমের দাম এক হাজার টাকা। একটি ব্রেডের এক স্লাইজের দাম তিন হাজার টাকা, দুই স্লাইজ ছয় হাজার টাকা। করোনাকালেও স্বাস্থ্যখাতে এই অবস্থা।

জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পিপিই ও কিট কেনার দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে এসে আমাদের এই রুগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা। মানুষ বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি মীনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে। মীনা কার্টুনের টিয়া পাখি (মিঠু) দিয়ে চলছে এই মন্ত্রণালয়।’

পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘এলাকায় গেলে মানুষেরা আমাকে অনুরোধ করেন যে আমি যেন সংসদে গিয়ে বলি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অন্যকোন দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়টাকে সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করতে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে মানুষের এই কথাটা নিবেদন করলাম।’

রওশন আরা মান্নান বলেন, সারা বিশ্বের মানুষ স্বাস্থ্য খাত ও নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে এখন ব্যস্ত। সেবাখাতের সাথে বেশি দুর্নীতি থাকে। এজন্য বলবো স্বাস্থ্যখাতে অবশ্যই দুর্নীতি রয়েছে। আমি এজন্য বলতে চাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি বিবৃতি দেন- এই খাতে কী ছিলো? এখন কী আছে? উনি কী করেছেন? কত ভেন্টিলেশন আছে? কেন কীট পাওয়া যায় না? কেন মানুষ মারা যাচ্ছে? করোনা নিয়ে সরকার কী করেছে এটা নিয়ে যদি বিবৃতি দিতেন।

মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেন, শুরু থেকে ব্যবস্থা নেয়া হলে করোনা এতটা ছড়াতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি আগে বলেছিলেন আমাদের এখানে তাপমাত্রা বেশি করোনা ছড়াবে না। এখন তিনি বলছেন করোনা দুই বা তিন বছরে যাবে না। জানি না সরকারি দপ্তরে বসে কীভাবে তারা কথা বলেন?

তিনি বলেন, নিম্নমানের পিপিই দেয়ার কারণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। নিম্নমানের স্বাস্থ্য সামগ্রী দেয়ার জন্য দেখলাম দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের কী জবাব দেবেন।

চুন্নু তার বক্তব্যে সকল এমপি-মন্ত্রী-সরকারি কর্মকর্তা সবাই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করবে। দেশে চিকিৎসা করবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশে যাবেন না- এমন নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করেন।

আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সঙ্কট নিয়ে অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আইসিইউ নিয়ে অনেক কথা হলো। ভেন্টিলেটর নিয়ে বিরাট হৈ চৈ। কিন্তু দেখা গেছে ভেন্টিলেটরের কোন প্রয়োজনই নেই। ভেন্টিলেটরে যারা গেছেন তাদের প্রায় সকলেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের চারশ ভেন্টিলেটর আছে। এর মধ্যে ৫০টিও ব্যবহার হয়নি। সাড়ে তিনশত ভেন্টিলেটর খালি পড়ে আছে। কারণ তখন মানুষ এটা জানতো না।

করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থা ওষুধ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে বলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রী এ সময় দাবি করেন। তিনি বলেন, করোনার কী চিকিৎসা লাগবে ডব্লিউএইচও তা বারে বারে চেঞ্জ করেছে। আমরাও সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কিন্তু আগে বলেনি পিপিই লাগবে। যখন বলা হলো তখন সারা বিশ্ব লকডাউন। এই লকডাউনের কারণে আমরা পিপিই পাচ্ছিলাম না। যন্ত্রপাতি পাচ্ছিলাম না। পরে আস্তে আস্তে ব্যবস্থা করছি। এখন আর সেই অভিযোগ নেই। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এখন হাইফ্লো অক্সিজেনের প্রয়োজনের কথা বলা হচ্ছে। আমরা এক হাজার অক্সিজেনের অর্ডার দিয়েছি। প্রায় ১০ হাজার নতুন সিলিন্ডার বানানো হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সংসদ সদস্যরা সংসদে আমাদের কেবল দোষারোপ করে গেছেন। আমরা কী কাজ করেছি তা আসেনি তাদের বক্তব্যে। কভিড আসার শুরু থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। চীনে কোভিড দেখা দেয়ার পরপরই আমরা পোর্টগুলোতে স্ক্রিনিংসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। প্রত্যেক জেলা উপজেলার হাসপাতালে কোভিডের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছি। আমরা জাতীয় পর্যায়ে কমিটি তৈরি করেছি। ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এই হার ভারতে ৬ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ শতাংশ যুক্তরাজ্যে ১৪ শতাংশ। এটা এমনিতেই হয়নি। সকলে কাজ করেছে বলেই এটা হয়েছে।

চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, পিপিই কীভাবে পরতে হবে এবং খুলতে হবে এই বিষয়টি জানা না থাকার কারণেই তারা আক্রান্ত হয়েছে। এজন্য আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। ফলে আক্রান্তের হার কমে গেছে।

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ক্রমে আমরা ইতোমধ্যে কোভিডের জন্যই শুধু দুই হাজার নতুন ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছি। ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরো দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছেন। সেটা ১৫ দিনের মধ্যেই নিয়োগ দিয়েছি। হটলাইনে এক থেকে দুই লাখ মানুষ ফোন করে স্বাস্থ্য পরামর্শ নিচ্ছেন।

মন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের ৮০ শতাংশ রোগীর কোন লক্ষণ দেখা দেয় না। ১৫ শতাংশের মাইল লক্ষণ দেখা দেয়। আর ৫ শতাংশের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। আমরা ৮০ শতাংশ রোগীকে বাসায় রেখে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।টেলিমেডিসিন চালু করেছি।

দেশের টেস্টিং ক্যাপাসিটি বাড়ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের মাত্র একটি টেস্টিং ল্যাব ছিলো। দেড় মাসে আমরা এখন ৬৮টি ল্যাব করেছি। দিনে মাত্র দেড়শটা টেস্টের ব্যবস্থা ছিলো সেটা এখন আঠার হাজারে উন্নীত হয়েছে। এটা এমনিতেই হয়নি। আমরা জানি আমাদের আরো টেস্ট দরকার। আরো করলে ভালো হয়। কিন্তু কোটি কোটি লোককে টেস্ট করতে পারবেন না। এটা আমাদের মানতে হবে।

সরকারের উদ্যোগের ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়েছে মন্তব্য করে জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। আমরা তাদের নিয়ে এসেছি। এখন তারা কভিড চিকিৎসা দিচ্ছে। তবে, এটা ঠিক তারা বিলটা একটু বেশি করছে। কভিড চিকিৎসায় ব্যয় একটু বেশি। আমরা বলেছি আমরা চার্জ ঠিক করে দেবো। এই সময়ে আপনারা লাভের চিন্তা করবেন না। মানুষকে সেবা দিন।

রোগী সেবা পাচ্ছে না এই অভিযোগ আর কোথাও নেই দাবি করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের মোট বেডের ৬০ শতাংশে এখন রোগী আছে। ৪০ শতাংশ বেড এখনো খালি পড়ে রয়েছে। প্রায় ১৪ হাজার বেড করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত আছে। সেখানে রোগী আছে চার হাজার।

তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও করোনার চিকিৎসা ঠিক মতো নেই। টিকাও আবিষ্কার হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের মৃত্যুর হার কম। তবে জীবন জীবিকার বিষয় আছে। সেই কারণে আমাদের সংক্রমনের হার কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু মৃত্যুর হার তুলনামুলকভাবে কম। মানুষ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে এই সংক্রমনের হারও কমবে বলে আশা করি।

সমন্বয়হীনতার অভিযোগ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্য
করোনা মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতার সংসদ সদস্যদের অভিযোগ অস্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোন সমন্বয়হীনতা নেই, ৫ মাস কিন্তু আমরাই মাঠে আছি। ২৫ দিনে বসুন্ধরায় দুই হাজার বেডের হাসপাতাল বানিয়েছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সকলের সহযোগিতা পেলে কভিড চলে যাবে। স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।’

ঢাকা মেডিকেলের দুর্নীতির অভিযোগ ‘টোল্যালি রং’
ঢাকা মেডিকেলের করোনা সম্পর্কিত চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক নয় বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের থাকা-খাওয়ার বিষয় নিয়ে যে কথা হয়েছে আমি খোঁজ নিয়েছি। কাল রাতে আমি এটা দেখেছি। ৫০টি হোটেল ভাড়া হয়েছে। সেখানে তিন হাজার ৭’শ মানুষ একমাস থেকেছে। প্রত্যেকটি রুমের ভাড়া ১১০০ টাকা। খাওয়ার খরচ যেটা বলা হয়েছে তা ‘টোটালি রং’। সেখানে দিনের তিনটি মিলের জন্য খরচ ৫০০ টাকা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত