সিলেটটুডে ডেস্ক

১৮ মার্চ, ২০২১ ০২:১৭

তিনি ভাড়াটে মামলাবাজ

ভাড়াটে সন্ত্রাসী, খুনির কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। এবার পাওয়া গেছে ভাড়াটে মামলাবাজ, যার কাজই অর্থের বিনিময়ে অন্যের হয়ে মামলা ঠুকে দেয়া। হয়রানি করা।

দেশের বিভিন্ন আদালত এবং থানায় এভাবেই শতাধিক ভুয়া মামলা করেছেন তিনি। এসব মামলা করতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে কখনও সাংবাদিক, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, কখনও এমপি-মন্ত্রীর কাছের লোক পরিচয় দিতেন।

অবশেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েছেন আজিজুল হক পাটোয়ারী নামের এই লোক। তার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। মঙ্গলবার রাতে মতিঝিলের আরামবাগ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) খিলগাঁও জোনাল টিম।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, এই প্রতারকের বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক নারী। মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা দেশে তার একটি মামলাবাজ সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

গত ১৬ মার্চ রাজধানীর খিলগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন চাঁদপুরেরই এক নারী।

মামলায় বলা হয়, তিনি প্রথম স্বামীর মৃত্যু পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্বামী প্রতারণা করে তার জায়গা-জমির কিছু অংশ বিক্রি করে দেন। বাকি জমি বন্ধক রেখে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেন। দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে টাকা উদ্ধারে হন্যে হয়ে ঘোরার সময় প্রথম পক্ষের এক দেবরের মাধ্যমে আজিজুলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। আজিজুল তাকে পুরো টাকা উদ্ধার করে দেয়ার আশ্বাস দেন। এ জন্য তাকে অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আর কাজ শুরুর আগেই দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা। আজিজুলের কথা শুনে পাঁচ লাখ টাকা দেন ওই নারী। টাকা নেয়ার পর টালবাহানা শুরু করেন আজিজুল। টাকা ফেরত চাইলে ভয়-ভীতিও দেখাতে থাকেন। নারী পাচারকারী, ইয়াবা কারবারী, দেহ-ব্যবসায়ী- এসব অভিযোগ এনে ওই নারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় পাঁচটি মামলা করেন আজিজুল, যার সবকটিতেই তিনি খালাস পেয়েছেন।

ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, কেবল এই নারীই নন, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ আজিজুল হক পাটোয়ারীর এমন সব মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছেন তারা।

ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, আজিজুল বাদী হয়ে মামলা করেছেন শতাধিক। এর মধ্যে ২৪টির নথি পেয়েছে ডিবি। বাকি মামলাগুলোর নথি জোগাড়ের কাজ চলছে।

মামলাগুলো ভিন্ন থানায়, ভিন্ন আসামির বিরুদ্ধে করা হলেও ঘটনা কাছাকাছি। বেশিরভাগ মামলা মারধর, হামলা ও ছিনতাইয়ের।

এসব অভিযোগ এনে ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় সৈকত পালসহ চারজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। মামলা নম্বর ৮/৩৩০। একই অভিযোগ এনে ওই বছরের ২৭ আগস্ট শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি মামরা করেন আজিজুল। মামলা নম্বর ৪৫/২৮৬। আসামি সেই সৈকত পালসহ কয়েকজন।

এখানেই থামেননি তিনি। দুই দিন পরই পল্টন এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে সৈকতকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন পল্টন থানায়। মামলা নং ৪৯/৪০৬।

থানা ভিন্ন হলেও মামলাগুলো দেখলে মনে হয়, সৈকত পাল যেন আজিজুল হক পাটোয়ারীর পিছু ছাড়ছেন না। আজ তেজগাঁও তো কাল শাহজানাহপুর, পরদিন পল্টন এলাকায় তাকে মারধর করে সব কিছু নিয়ে নিচ্ছেন সৈকত। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন।

তাকে বারবার আসামি করার কারণ জানতে চাইলে ই-কর্মাস ব্যবসায়ী সৈকত পাল জানান, ২০১৮ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেয়নি। তার শ্বশুর সুরেশ সরিষার তেল কোম্পানির কর্ণধার সুধীর সাহা। সৈকতকে অপহরণের জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন সুধীর সাহা। তখন পুলিশ অপহরণকারীদের ধরে ফেলে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সুধীর সাহার নাম আসে। ওই মামলায় সুধীর সাহা জেলও খাটেন। এরপর থেকেই সৈকতকে জেলে পুরতে মরিয়া হয়ে ওঠেন সুধীর। নিজে ১৭টি মামলা করেন। আজিজুল ও অন্য এক নারীকে দিয়ে করান আরও ৮টি মামলা।

সৈকত বলেন, ‘আমাদের বিয়ে শ্বশুর মেনে নেননি। আমাকে অপহরণ করাতে গিয়ে উনি জেলে যান। এরপর থেকে তিনি আমার নামে বিভিন্ন মামলা করেছেন। উনার পক্ষে যত মামলা করা সম্ভব ছিল করেছেন। এরপর তিনি মামলা করার জন্য আজিজুল হক পাটোয়ারীকে ভাড়া করেন। আরেকজন নারীকে দিয়েও আমার বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন।’

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, আজিজ তার অভিনব এই অপকর্মে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন গার্ডিয়ান বিডিনিউজ এবং দৈনিক আমার সংগ্রাম নামের দুটি নামস্বর্বস্ব পত্রিকাকে। এসব পোর্টাল ও দৈনিক মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া সংবাদ পরিবেশ করে মানুষকে হয়রানি করে।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, আজিজুল হক পাটোয়ারী ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতারণার এক মামলায় শাহরাস্তি থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। সে সময় তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা ও বেশকিছু অভিযোগ ছিল।

তারা জানান, ২০০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বিচার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব ও হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধন এবং প্রতিবাদ মিছিল করেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। সে সময় শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকাও দাহ করেন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেকে তাঁতী লীগের এক নম্বর সদস্য পরিচয় দিতে শুরু করেন আজিজুল।

তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, আজিজুলের মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক মামলা থেকে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও বাদ যাননি। তদন্ত পছন্দমতো না হওয়ায় বা অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য তিনি নিজে ও তার ছেলেকে দিয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, শাহরাস্তি উপজেলার ইউএনও, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, তৎকালীন ওসি শাহ আলমসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করেছেন তাদের।

আজিজুল হক পাটোয়ারীকে দিয়ে যারা মামলা করিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম।

তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অন্যের হয়ে মামলা করার অভিযোগ অনেক। আমাদের কাছে অভিযোগগুলো আসছে। যারা তাকে দিয়ে এসব মামলা করিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত