সিলেটটুডে ডেস্ক

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২৩:৫২

বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি গুলি করেছিলো মেজর নূর

যে খুনি মেজর নূরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করতে সম্মত হয়েছে কানাডা, সেই মেজর নূরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি গুলি করেছিলো। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’ বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের বরাতে সেই বক্তব্য উঠে এসেছে।

বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা আরেক বরখাস্ত মেজর বজলুল হুদাকে নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণার দিন থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে অন্য চার খুনির সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় তার।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ২০০০ সাল থেকে কানাডায় পালিয়ে আছে। শুক্রবার মন্ট্রিয়লে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তাকে বহিঃসমর্পণের বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে।

সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খানের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, মেজর নূর এবং মেজর হুদা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছিলো।

তখনকার অবস্থা বর্ণনা করে সাক্ষী আব্দুর রহমান রমা জানান: “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরোজা খুলে বাইরে এসে বলেন, দুস্কৃতকারীরা সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করেছে। দ্রুত লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি কিছু আর্মি গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। বঙ্গবন্ধুকে তখন পি.এ এবং রিসেপশনিস্টের রুমে কথা বলতে দেখি। দোতলায় উঠে দেখি বেগম মুজিব ছোটাছুটি করছেন। তিন তলায় গিয়ে আর্মিরা বাসা আক্রমণ করেছে বলে শেখ কামালকে ঘুম থেকে উঠাই। কামাল দ্রুত একটা শার্ট এবং প্যান্ট পরে নীচের দিকে চলে যান। তার স্ত্রী সুলতানা কামাল দোতলায় আসেন। দোতলায় একইভাবে শেখ জামালকে ঘুম থেকে উঠাই। শেখ জামালও দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে মায়ের রুমে যান, সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। তখন খুব গুলি হচ্ছিলো। এই পর্যায়ে শেখ কামালের আর্তচীৎকার শুনতে পাই।

এর আগেই বঙ্গবন্ধু নীচে নেমে আবার দোতলায় চলে এসেছিলেন। গুলি থামলে তিনি তার রুম থেকে বের হওয়ামাত্র আর্মিরা তাকে তার বেডরুমের সামনে ঘিরে ফেলে।”

রমা জানান: বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, তোরা কি চাস? কোথায় নিয়া যাবি আমাকে? তারা তখন বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। দুই/তিন ধাপ নামার পর নীচের দিক থেকে আর্মিরা গুলি করে।

বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাবার সময় তিনি আহত অবস্থায় মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুলকে আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সেনা সদস্যদের বলেন, এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমাদের এখানে থাকে, একে কে গুলি করলো?

সাক্ষী হিসেবে সেলিমও জানান: ওই সময়েও তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেনা সদস্যদের বলেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়া যাবি? কি বলবি? বেয়াদবি করছ ক্যান? এর কিছুক্ষণ পরই সিঁড়ির দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর গুলি।

এ দুজন শুধু হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিলেও খুনিদের যে সেনা সদস্যরা চিনতেন তারা আদালতের কাছে পরিচয় জানিয়েছেন। তাদের অন্যতম মামলার সাক্ষী এবং নিরাপত্তারক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস।

তিনি বলেছেন: মেজর মহিউদ্দিন তার ল্যান্সারের ফোর্স নিয়ে গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে যায়। পরে কয়েকজন ফোর্স নিয়ে দোতলার দিকে যায় ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর। যাবার সময় তাদেরকেও পেছন পেছন যেতে হুকুম দেয়।

হাবিলদার কুদ্দুস জানান: ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর যখন সিঁড়ির চৌকির ওপরে, তখন আগেই দোতলায় যাওয়া মেজর মহিউদ্দিন ও তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামিয়ে আনছিলো। মেজর নূর ইংরেজিতে কিছু বললে মেজর মহিউদ্দিন এবং তার ফোর্স একপাশে চলে যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা কি চাস? সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু, সেসময়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি গুলি করা মেজর নূর শেখ কামালের বন্ধু ছিলো বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী এবং বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ মুহিতুল ইসলাম। তিনি জানান, মেজর (বরখাস্ত) নূর জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ১২ নম্বর থিয়েটার রোডে জেনারেল ওসমানীর অফিসে মেজর নূরের সঙ্গে শেখ কামালের পরিচয় হয়।

‘শেখ কামালের বন্ধু হিসেবেও নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতো,’ বলে জানান মুহিতুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের এডিসি হিসেবেও কাজ করেছে মেজর নূর। পরে তার চাকুরি চলে যায়।

অন্যদের সঙ্গে মেজর নূরের চাকুরি চলে যাওয়ার বিষয়টা প্রধান দুই খুনির একজন বরখাস্ত মেজর সৈয়দ ফারুক রহমানের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ১৬৪ ধারায় ফারুক জবানবন্দিতে বলেন: ওইসময় লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু অফিসার ও জওয়ান গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি তছনছ করে। তাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে মেজর ডালিম, মেজর নূর ও আরো কয়েকজনের চাকরি চলে যায়।

জাহিদ নেওয়াজ খান তান বইয়ে লিখেছেন: সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটা বিস্ময়কর যে কিছু সেনা অফিসার একজন মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পর তাদের শাস্তি হয়েছে শুধু চাকুরিচ্যুতি! কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবজাত ভালোবাসার কারণে তাদের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। এ কারণে মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পরও ডালিম এবং নূরের কারাদণ্ডের মতো শাস্তি হয়নি। এর প্রতিদান তারা দিয়েছে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে।

‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’ বইয়ে আছে, তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল হামিদ। সাক্ষী হিসেবে আদালতকে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সনের ১৪ আগস্ট বিকেলে টেনিস খেলার সময় লক্ষ্য করেন যে, চাকুরিচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর নূর টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। এটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। খেলা শেষে তিনি মেজর নূরকে জিজ্ঞেশ করেন, তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আসো? জবাবে নূর জানায়, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে খেলতে আসে।’

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর নূরসহ অন্য খুনিদেরকে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত নূরকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু, দেশে না ফিরে সে পালিয়ে যায়। পরে চলে যায় কানাডায়। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে বেশ কয়েকবার আবেদন করলেও তা প্রত্যাখান করে কানাডা রিফিউজি বোর্ড।
সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত