০৫ জুন, ২০১৭ ০১:২৩
দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়া সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এই বছরেও সুরাহা হয় হয়নি মিতু হত্যা তদন্তে। জানা যায় নি কে কারা হত্যা করেছে এই গৃহবধূকে।
বিভিন্ন সময়ে মিতু স্বামী আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে অভিযুক্ত করা হলেও তদন্তকারীরা এখনো তা নিশ্চিত করেননি। বাবুল আক্তারকে রাতে জিজ্ঞাসাবাদ, চাকরী থেকে অবসর নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। তবে বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো খোলেনি চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের জট।
সোর্স কামরুল হক সিকদার মুছাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় জানা গেছে। তবে মূল ব্যক্তি মুছাকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারিনি। মুছাকে পেলে খুনের নির্দেশদাতা কিংবা নেপথ্যের বিষয় জানা যেতো।
মামলার ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার বলেন, মুছাকে পলাতক দেখিয়ে মামলাটির অভিযোগপত্র দেয়ার কথা ভাবছে পুলিশ। তিনি বলেন, মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত আটজনের মধ্যে রাশেদ ও নবী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। ওয়াসিম, শাহজাহান, আনোয়ার ও ভোলা কারাগারে রয়েছে। ঘটনার ছয়দিনের মাথায় শাহজামান রবিন নামে আরও এক যুবককে নগরীর শীতল ঝর্ণা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরবর্তীতে তদন্তে খুনের ঘটনায় এখনো রবিনের স¤পৃক্ততা পাওয়া না গেলেও এক বছর ধরে কারাবন্দী রয়েছে রবিন। পুলিশের দাবি অনুযায়ী ঘটনার মূল হোতা মুছা ও সহযোগী কালু এখনো পলাতক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান জানান, মুছা পলাতক রয়েছে। তাকে পাওয়া গেলে মিতু হত্যার রহস্য জানা যাবে। মুছাকে ধরতে ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এখনও মুছাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত যদি তাকে না পাওয়া যায়, তাহলে তাকে বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দেওয়ার চিন্তা করতে হবে।
মুছা ধরা পড়লেই ঘটনার আসল রহস্য বের হবে-পুলিশ কর্মকর্তারা এ ধরণের বক্তব্য দিলেও মুছা ও ঘটনার সঙ্গে ‘জড়িত’ কালুকে ধরতে পুলিশের কতটুকু তোড়জোড় চালাচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। অন্যদিকে মুছার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, ‘খুনের ঘটনার সতেরো দিনের মাথায় বন্দর এলাকা থেকে মুছাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যে পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে তাকে ধরা হয়েছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বিষয়টি জানা যাবে। অথচ মুছাকে না পাওয়ার ব্যাপারে পুলিশ যা বলছে তা হাস্যকর।’
গত বছরের ৫ জুন ভোরে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে নগরীর জিইসি মোড়ে সন্তানের সামনেই গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। ঘটনার পর খুনিদের তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করে এবং অন্যরা হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। শুরুতে পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত শুরু করে।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিকানার সূত্র ধরে ২০ দিনের মাথায় পুলিশ রাঙ্গুনিয়া থেকে ওয়াসিম, আনোয়ার ও শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করে। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে আদালতে জবানবন্দি দেয় এবং জড়িত অন্যদের নাম উল্লেখ করে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন জড়িত নুরুন্নবী ও রাশেদ রাঙ্গুনিয়ার রাণীরহাট এলাকায় ইটভাটায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
এছাড়া নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকার একটি রিকশার গ্যারেজ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় অস্ত্রের মালিক ও যুবলীগ নেতা এহতেশামুল হক ভোলা এবং তার সহযোগী মনির হোসেনকে। মনির জামিনে বেরিয়ে আসলেও ভোলা এখনো কারাগারে আছেন। অস্ত্রটি মিতু হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত হওয়ার ব্যাপারে ভোলা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
গত একবছরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান মামলার বাদী বাবুল আক্তার ও নিহত মিতুর বাবা মায়ের সঙ্গেও একাধিকবার কথা বলেন। মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন শুরুতে হত্যার সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত নয় দাবি করলেও পরে দাবি করেন, বাবুলের পরকীয়া স¤পর্ক আছে এবং এ কারণে মিতু হত্যার সঙ্গে তার স¤পর্ক আছে।
গত বছরের ২৪ জুন ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ বাবুল আক্তারকে ডেকে নিয়ে ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওইদিনই বাবুল আক্তার পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন বলে জানা গেছে।
মুছা পলাতক, মানতে রাজি নন তার স্ত্রী
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার মূলহোতা হিসেবে সন্দেহভাজন মুছাকে এক বছরেও খুঁজে পায়নি পুলিশ। পুলিশের দাবি, মুছাকে পাওয়া গেলে মিলবে মিতু খুনের রহস্য।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. কামরুজ্জামান জানান, মিতু খুনের মূলহোতা মুছা এখনো পলাতক। তাকে পাওয়া গেলেই খুনের রহস্য কিংবা নির্দেশদাতা কে তা জানা যাবে।
কিন্তু মুছা পলাতক তা মানতে রাজি নন তার স্ত্রী পান্না। পান্না আক্তার বলেন, ‘একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হলো। আর সেই খুনের মুল আসামি মুছা। অথচ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ বিষয়টি কেমন জানি হাস্যকর।’
পান্না বলেন, ‘ঘটনার সতেরো দিনের মাথায় (২০১৬ সালের ২২ জুন) বন্দরের বাসার নিচ থেকে মুছাকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের যে কর্মকর্তা মুছাকে আটক করেছে তার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আমি চিনি এবং তাঁর নামও জানি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মুছা কোথায় জানা যাবে। মুছাকে পেলে পুলিশের ভাষ্যমতে মিতূ হত্যার জটও খুলতে পারে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে পান্না আক্তার বলেন, ‘মুছাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ওই পুলিশ কর্মকর্তা এখন কোথায়। তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না। মুছাকে কেন হাজির করা হচ্ছে না। তাকে হাজির না করার পেছনে বড় ধরনের কোনো নাটক রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
পান্না বলেন, ‘ভোলার সঙ্গে মুছার বালুর ব্যবসা ছিল। কালামিয়া বাজারের ভাড়া বাসায় আমরা থাকতাম। মিতু খুনের ঘটনার পরদিনও মুছা কালামিয়া বাজারের বাসায় ছিল। দুইদিন পর বন্দর এলাকায় নবীর বাসায় যাই আমরা। সেখান থেকে পুলিশ তাকে আটক করেছে। মিতু খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যাদের আটক করেছে সবাইকে পুলিশ হাজির করেছে শুধু মুছা ছাড়া। আমি এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি মুছা একদিন ফিরে আসবে।’
আপনার মন্তব্য