সিলেটটুডে ডেস্ক

০১ জুন, ২০১৮ ২৩:১৬

‘আমার জামাই কিছু করে নাই’

একরামুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ স্ত্রীর

একটি অডিওক্লিপ নিয়ে চলছে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা। বৃহস্পৃতিবার এই অডিওক্লিপটি সবার সামনে নিয়ে আসেন আয়েশা বেগম। তিনি চলমান মাদববিরোধী অভিযানে 'কথিত বন্দুকযুদ্ধে' নিহত টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের স্ত্রী।

বৃহস্পতিবার কক্সবাজার প্রেসক্লাবে একসংবাদ সম্মেলনে ১৪ মিনিটের এই অডিওক্লিপ শুনিয়ে আয়েশা বেগম দাবি করেন, তাঁর স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

অডিওক্লিপটিতে একারমুলের সাথে তাঁর ও তাঁর মেয়েদের শেষ কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এই অডিও রেকর্ডে গুলি, গালাগালি ও সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। পাশাপাশি একজন নারীকে 'আমার জামাই কিছু করে নাই' বলে আর্তনাদ করতে শোনা যায়। এই নারীকণ্ঠ তাঁর নিজের বলে দাবি করেন আয়েশা।

চারটি অডিও ক্লিপ সংবাদ সম্মেলনে শুনিয়ে আয়েশা বলেন, সেখানে শুরুতে মেয়ের সঙ্গে একরামের কথা, পরে তার নিজের কণ্ঠ রয়েছে।

এ ব্যাপারে র‌্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “অডিওটা আমরা শুনেছি। অনেক রকমের অডিও হয়, বিষয়টি আমরা দেখছি।”

সারা দেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ১৩ দিনে নিহত ১২২ জনের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক একজন, যিনি গত ২৬ মে রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে র‌্যাবের দাবি।

টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুলকে র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণনা করা হয় ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ এবং ‘ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার’ হিসেবে। তবে তার পরিবার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম তার দুই মেয়েক নিয়ে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে অভিযোগ করেন, জমি সংক্রান্ত বিষয়ের কথা বলে সেই রাতে তার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা। পরে মেরিন ড্রাইভে নিয়ে একরামকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে আয়েশা বলেন, তিনি গত ২৬ মে রাতে তাঁর স্বামীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। সাংবাদিকদের অডিওটির চারটি ক্লিপ দিয়ে নিহত কমিশনারের স্ত্রী অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে “ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।”

আয়েশা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুবিচার প্রার্থনা করেন।


আয়েশা সাংবাদিকদের বলেন, একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোনের কারণে গত ২৬ মে রাত ৯টার দিকে একরাম বাড়ি থেকে বের হন। রাত ১১টার সময়ও বাড়ি ফিরে না এলে, তার মেয়ে সোয়া ১১টার দিকে ফোন করে।

যা আছে অডিওতে

সংবাদ সম্মেলনে একরামের স্ত্রী আয়েশা বলেন, সেদিন রাত ১১টা ৩২ মিনিটের পর তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর সেটা যে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে,মোবাইলের ওই রেকর্ড যাচাই করলেই তা বোঝা যাবে।

তিনি দাবি করেন, একরাম ইয়াবার কারবারে জড়িত ছিলেন না। তার ব্যাংক ব্যালেন্স বা সম্পদেও অস্বাভাবিক কিছু নেই।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে আয়েশা তার দুই মেয়ের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন সরকারপ্রধানকে।

আয়েশার বিবরণ অনুযায়ী, একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোন পেয়ে ২৬ মে রাত ৯টার দিকে একরাম বাড়ি থেকে বের হন। রাত ১১টার সময়ও বাড়ি ফিরে না এলে তার মেয়ে ১১টা ১৩ মিনিটে ফোন করে তার বাবাকে।

অডিওতে শোনা যায়, মেয়ে জানতে চাইছে তিনি কোথায় আছেন। জবাবে বাবা বলেন, ‘মেজর সাহেব’ ডেকেছিলেন, ওখান থেকে তিনি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছেন।

টিএনও অফিস থেকে আসতে দেরি হবে কি না- মেয়ের সেই জিজ্ঞাসায় বাবা বলেন, দেরি হবে না। এরপর ফোন কেটে যায়।

রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একরামের মেয়ে আবারও ফোন করে জানতে চায় তিনি কোথায় আছেন।

অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, “আমি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মা।”

ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে- মেয়ের এ জিজ্ঞাসায় অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, “বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ, ঠিকাছে? ঘুমাও।”

রাত ১১টা ৩২ মিনিটে আবারও মেয়ে ফোন করলে তার বাবা বলেন, হ্নীলায় যাচ্ছেন।

কেন সেখানে যেতে হচ্ছে জানতে চাইলে উত্তর আসে, তিনি ‘জরুরি কাজে’ যাচ্ছেন।

মেয়ে তার কাছে আবারও জানতে চায়- কেন?

ধরা গলায় জবাব আসে, “যাচ্ছি আম্মু ঠিকাছে … যেতে হচ্ছে তা…।”

মেয়ে তখন জানতে চায়, তার বাবা কেন কাঁদছে।

এই অবস্থায় ফোন নেন আয়েশা। তিনি হ্যালো হ্যালো করতে করতেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে আবার ফোন করেন একরামের স্ত্রী। ফোন রিসিভ হওয়ার আগে তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন যেন একবার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়।

ফোন রিসিভ হলে আয়েশা বলেন, “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে? হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো কে ওইটা, ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে? আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো, হ্যালো…।”

এমন সময় ফোনের অপর পাশে কাউকে বলতে শোনা যায় “… তুমি যেটা বলছ,… জড়িত না? কেউ একজন বলেন, নাহ। এরপর অগ্নেয়াস্ত্র কক করার শব্দ এবং দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে মরণাপন্ন কারও চিৎকার।

ওই আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন একরামের স্ত্রী ও মেয়েরা।

আয়েশা বলেন, “ও আল্লা আমার জামাই কিছু করে নাই। আমার জামাই কিছু করে নাই। আমরা বিনা দোষী। আমার জামাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই।”

এ সময় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কথা শোনা গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বার বার বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে গালিগালাজের আওয়াজও শোনা যায়।

এক পর্যায়ে একরামের স্ত্রী চিৎকার করে জানতে চান- “আপনারা কোথায়, আপনারা কোথায়…।”

অপরপ্রান্তে বাশির শব্দ বাড়তে থাকে। গালিও শোনা যায়।

কাঁদতে কাঁদতে আয়েশা বলতে থাকেন, “আমার জামাই কিছু করে নাই। কমিশনার কিছু করে নাই। আপনারা শুয়ারের বাচ্চা কেন বলতেছেন? উনি কিছু করে নাই। আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, কমিশনার কিছু করে নাই, উনাকে কেন মারতাছেন? আপনারা উনাকে কেন মারতাছেন?”

অন্য প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কণ্ঠ শোনা গেলেও তাদের কথা বোঝা যাচ্ছিল না। কিছু একটা খুঁজে বের করতে কেউ নির্দেশ দেন। এরপর একজন বলেন, বাড়ি কই বাড়ি? এরপর গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা যায়।

পরে আরও তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়, সঙ্গে অকথ্য গালি। ফোনের এ প্রান্ত থেকে আয়েশা বলতে থাকেন, তার স্বামী কিছু করেনি, কেন তাকে মারা হচ্ছে।

এক পর্যায়ে ‘খোসাগুলো’ খোঁজার কথা বলা হয় ফোনের অন্য প্রান্তে। পরে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। একজন বলেন, “আর লাগবে না, খোসাগুলো দেখ।”

১০ রাউন্ড গুলির কথা বলেন একজন। খোসা খোঁজাখুঁজি করেন। আটটি খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানান একজন। সাইরেন বাজতে থাকে। আরও খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হয়।
সূত্র: ডেইলি স্টার ও বিডিনিউজ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত