সিলেটটুডে ডেস্ক

১১ আগস্ট, ২০১৭ ০১:১৯

প্রধান বিচারপতির অপসারণ চাইলেন খাদ্যমন্ত্রী

সগবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার অপসারণ দাবি করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী এ দাবি জানান। ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের জিল্লুর রহমান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁর (প্রধান বিচারপতি) যদি সামান্যতম জ্ঞান থাকে, সামান্যতম বুঝ থাকে, তাহলে স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। তা না হলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন।’

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে কামরুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, বিএনপির সুরে কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে বেশি দিন এই মসনদে থাকতে পারবেন না।

কামরুল বলেন, ‘সময় এসেছে, এখন আর চোখ বুজে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখন কে কী রক্ত চক্ষু দেখাবেন, সেই রক্ত চক্ষু সহ্য করব না। অবশ্যই আমরা তাঁর অপসারণ চাই।’

ষোড়শ সংশোধনীর পর্যবেক্ষণ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনার ওপরে কে আছর করেছে? ডক্টর কামাল হোসেন, শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুল—কারা আছর করেছে আপনার মাথায়? কাদের নির্দেশে, কাদের ড্রাফট (খসড়া) করা থেকে এই পর্যবেক্ষণের অংশটুকু আমরা বুঝতে পারছি না। আপনি এই কথাগুলো বলেছেন। আমাদের উসকে দিচ্ছেন। আবার বলছেন যে রাজনীতি না করার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাতির জনককে যখন কেউ খাটো করে দেখার চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ অপমান করে, মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ খাটো করে দেখার চেষ্টা করে, আমাদের আদর্শের বিরুদ্ধে যদি কেউ কথা বলে, আমাদের দেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যদি কথা বলে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যদি কেউ কথা বলে, গণতন্ত্র হত্যায় পরোক্ষভাবে যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে—তাঁর বিরুদ্ধে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কথা বলার অধিকার আমার অবশ্যই আছে।’

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে বলেন, ‘ভাবখানা এই যে পার্লামেন্টে যদি জজের বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেইন (অভিযোগ) যেত, তাহলেই তিনি বহিষ্কৃত হতেন। তা নয়। সেখানে কী ছিল? সেখানে ছিল কমপ্লেইন (অভিযোগ) দেওয়ার পর তদন্ত কমিটি হবে। সেই তদন্ত কমিটিতে বাইরের লোক থাকারও প্রভিশন (বিধান) রাখা হয়েছিল। এবং সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট (প্রতিবেদন) যদি সঠিক হয়, পার্লামেন্ট সদস্যরা যদি সন্তুষ্ট হন, তাহলেই সেখানে একটা বিচারের ব্যবস্থা করা হতো। এটা নয় যে একতরফাভাবে কোনো কিছু পার্লামেন্টে গেলেই শুধু পাস করে দেওয়া হবে। নো।’

প্রধান বিচারপতির নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্বাচীন বলা হয়। তো সেই অর্বাচীন দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, সেই রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি কী হয়? এই কথা আমি ওনার ওপরই ছেড়ে দিলাম।’

ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে বিশেষ অতিথি আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমাদের বিচারকেরা যা বলতে চেয়েছেন, আমি সামান্যতম বুঝেছি। তার সঙ্গে আমাদের কিছু বিশেষজ্ঞও বিচারকদের সঙ্গে সায় দিয়েছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলি, তাঁদের বানানো হয়েছিল অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু)। আমরা আশা করেছিলাম, তাঁরা পক্ষে-বিপক্ষে সব পথে আর্গুমেন্ট (যুক্তি-তর্ক) করবেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁরা এগুলো বলেননি। আর জজ সাহেবেরা যে রায় দিয়েছেন, সেই রায়ের মধ্যে কতগুলো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন আমাদের বিচারকবৃন্দ। তাতে আজ জাতি অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ।’

আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ রেজাউর রহমান, সংসদ সদস্য সাহারা খাতুন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী নজিব উল্লাহ হিরু প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত ১ আগস্ট বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়।

এরআগে গত ৩ জুলাই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

এ মামলায় নয়জন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল ও এজে মোহাম্মদ আলী।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরো বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।

আদালত রায়ে আরো বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সাংসদরা ভোট দিতে পারেন না। তাঁরা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সাংসদদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাঁরা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

রায়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত