নবীগঞ্জ প্রতিনিধি

০৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ২৩:৩৭

মৃত্যুর আগে ‘শহীদ ধ্রুব’র স্মৃতিস্তম্ভ’ দেখে যেতে চান মুক্তিযোদ্ধা রশীদ

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও শনাক্ত হয়নি শহীদ ধ্রুব’র কবর

১৯৭১ সালে জন্মভূমির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন নবীগঞ্জের ধ্রুব। স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের বিজয় অর্জনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেছেন। ৪ ডিসেম্বর নবীগঞ্জ শহর মুক্ত করতে পাক হানাদারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন এ বীর সেনানী।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়েছে। অথচ এই বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো প্রদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর পার হলেও তার স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হয় না। এমন কী অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে তার শেষ সমাধিটুকুও।

ধ্রুব’র সহযোদ্ধা ও একাত্তরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রশীদ বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদ এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে অশ্রুসিক্ত নয়নে ধ্রুব’র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ধ্রুব’র অবদানের কথা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ, বাহুবলে শহীদ ধ্রুব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৫ নভেম্বর নবীগঞ্জে আসেন মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। তার পরপর গজনাইপুরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই যুদ্ধে ধ্রুব’র বন্দুকের গুলিতে ৪জন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। তারপর ধ্রুব নবীগঞ্জের চৌধুরী বাজারে আমার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা (রশীদ) বাহিনীর সঙ্গীয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বাহুবল উপজেলায়ও মুক্তি বাহিনীর সাথে বীর সেনানী ধ্রুব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।’

তিনি বলেন, ‘৩ ডিসেম্বর রাতে আমার নেতৃত্বে (রশীদ বাহিনী) ৩৫ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা নবীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ৪ ডিসেম্বর ভোরে গিয়ে নবীগঞ্জে পৌঁছাই। সেখানে অবস্থানকালে নবীগঞ্জে পাক-হানাদার বাহিনীর মূল ঘাঁটি হিসিবে চিহ্নিত নবীগঞ্জ থানাতে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ সময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। আমি ও ধ্রুবসহ বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা নবীগঞ্জ থানার গেটের নিকটে যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর একটি গুলি ধ্রুব’র মাথায় এসে লাগে। এতে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে প্রাণ হারায় ধ্রুব। ওই যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে আরো ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরে মুক্তি বাহিনী পিছু হটে। তখন নিহত ধ্রুব’র লাশ নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে পড়ে থাকে। সেখানেই তার লাশে পচন ধরে। ৬ ডিসেম্বর নবীগঞ্জকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা রশীদ জানান, নবীগঞ্জ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান নবীগঞ্জ থানার গেটের সামনেই মাটি চাপা দেওয়া হয় ধ্রুবকে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে ধ্রুব’র স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার আশ্বাস দিয়ে আসলেও স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এনিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশীদ।

মুক্তিযোদ্ধা রশিদ আরও বলেন, ‘মৃত্যুর আগে যদি শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখে যেতে পারি তাহলে মরার পরেও শান্তি পাবো। এতে ধ্রুব’র আত্মাও শান্তি পাবে।’

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গলের কোনো এক চা-বাগানের দরিদ্র শ্রমিক পিতা মাতার সন্তান ছিলেন শহীদ ধ্রুব। পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র সমাধিটি আজও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে সম্মান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের। কিন্তু ঠিকানা বিহীন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ধ্রুবের সমাধি আজও চিহ্নিত হয়নি। এই অবস্থায় নবীগঞ্জ থানা সংলগ্ন নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের পাশে রাজনগর গ্রামের কবর স্থানের এক পাশে পড়ে আছে।

এ ব্যাপারে দিনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ তনুজ রায় বলেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও তার সঠিক সমাধিস্থল নির্ধারণ করা হয়নি। তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো স্মৃতিস্বারক বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। নবীগঞ্জবাসীর দাবি অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হউক।’

নবীগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র (১) এটিএম সালাম বলেন, ‘স্বাধীনতার ইতিহাস অতি নির্মম, নবীগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব নিহত হন। নবীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে এক বীর সেনানীর নাম ধ্রুব। শহীদ ধ্রুবের সমাধিস্থল সনাক্ত করে সরকারিভাবে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে শাহাদাৎ বার্ষিকী পালনের জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও ধ্রুব’র সমাধিস্থল শনাক্ত করতে না পারার ব্যাপারে ব্যর্থতা রয়েছে স্বীকার করে নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহবায়ক ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘শহীদ ধ্রুব সমাধিস্থল শনাক্ত করা যায়নি বলে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধ্রুব’র সমাধিস্থল শনাক্ত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’

মহান মুক্তিযুদ্ধে যে কিশোর একদিন মাতৃভূমির জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। ঠিকানাহীন সেই কিশোরের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে কী তার শেষ স্মৃতিটুকুও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত