নিজস্ব প্রতিবেদক

১৭ জুলাই, ২০২২ ১২:৫১

দেড় ঘন্টার বৃষ্টিতেই কেন তলিয়ে গেলো সিলেট নগর

টানা একসপ্তাহ ধরে চলা দাবদাহে অতিষ্ঠ ছিল জনজীবন। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। অবশেষে শনিবার মধ্যরাতে স্বস্তির বৃষ্টি আসে সিলেটে।

কিন্তু এই স্বস্তি স্থায়ী হয়নি। দেড়ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরের বেশিরভাগ এলাকা। বাসা বাড়িতে ঢুকে পড়ে পানি। মাত্র বন্যার ধকল কাটানো নগরবাসীর জন্য এই জলাবদ্ধতা আসে চরম দুর্ভোগ হয়ে।

স্থানীয়রা বলছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বন্যার পর ড্রেনে জমা হওয়া আবর্জনা পরিষ্কার না করার কারণেই বৃষ্টিতে এই ভোগান্তি। সিসিক কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, বন্যার পর ড্রেন পরিষ্কার করা হয়নি। এতে পানি আটকে তলিয়েছে নগর।

শনিবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। রাত প্রায় ১ টা পর্যন্ত চলে বৃষ্টিপাত। এতে তলিয়ে যায় নগরের বেশিরভাগ এলাকা। অনেক উঁচু এলাকাতেও পানি উঠে যায়। তবে বৃষ্টি থামার পর সকালে এই পানি নেমে গেছে।

রাতে নগরের সোবহানিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কে হাঁটুর উপরে পানি জমে গেছে। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।

সোবহানীঘাট ছাড়াও বৃষ্টিতে নগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, লোহারপাড়া, বড়বাজার, লামাবাজার, মদিনামার্কেট, চারাদিঘিরপাড়, সওদাগরটুলা, যতরপুর, উপশহর, শিবগঞ্জ, শাপলাবাগ, তালতলা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, জল্লারপাড়, ভাতালিয়া, কানিশাইল, মজুমদারপাড়া, মেন্দিবাগ, দরগামহল্লা, লালদিঘিরপার, কুয়ারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে।

এসব এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি উঠে যায়। মধ্যরাতে ঘরে পানি ঢুকায় মানুষজন পরেন চরম দুর্ভোগে।

নগরের রায়নগর এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা মাহমুদ বলেন, ‘বৃষ্টি শুরুর আধঘণ্টা পরই ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। একমাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার এমন দুর্ভোগে পড়তে হলো।’

উপশহর এলাকার বাসিন্দা রাতুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে বন্যার সময় প্রায় ১৫ দিন ঘরে পানি ছিল। পানি নামার পর সবকিছু পরিষ্কার করে কিছুদিন আগে মাত্র ঘরে উঠেছি। আবার পানি ঢুকে পড়ল। আমাদের দুর্ভোগ যেন শেষই হচ্ছে না।’

শনিবার রাতের বৃষ্টিতে পানি ঢুকে পড়ে সিলেটের বইয়ের বাজার হিসেবে পরিচিত জিন্দাবাজারের রাজা ম্যাবশনেও।

এই মার্কেটের ব্যবসায়ী কলিম উদ্দিন বলেন, ‘বৃষ্টিতে মার্কেটে পানি ঢুকে কয়েক লাখ টাকার বই ভিজে নষ্ট হয়েছে। এর আগে ১৮ জুন বন্যার পানি ঢুকে মার্কেটের কোটি টাকার বই নষ্ট হয়েছিল।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুদিন পরপর এই যন্ত্রণা থেকে আমরা কীভাবে নিস্তার পাব।’

গত ১৫ জুন থেকে তৃতীয় দফায় বন্যা শুরু হয় সিলেটে। এতে তলিয়ে যায় সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা। নিন্মাঞ্চলে এখনও বন্যার পানি থাকলেও নগর থেকে পানি নেমেছে। এর আগে গত মে মাসে আরেক দফা বন্যায় পানি ঢুকে নগরের বেশিরভাগ বাসা বাড়িতে।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রিপন চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাসায়ও পানি ঢুকে গেছে। নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণের ফলে এমনটি হচ্ছে।’

রিপন বলেন, ‘খোলা ড্রেন হলে আবর্জনা আটকে থাকত না, কিন্তু বক্স কালভার্টে আবর্জনা আটকে থাকছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না। এতে অল্প বৃষ্টিতেই নগর তলিয়ে যাচ্ছে।’

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু বলেন, ‘বন্যায় বিভিন্ন স্থান থেকে ময়লা আবর্জনা এসে ড্রেনে জমা হয়েছে। সিসিকের উচিত ছিল বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা। কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের দোষে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

নগর তলিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘নগরের ড্রেনগুলো খুব সরু আকারে নির্মাণ করা হয়েছে, ছড়াগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না।’

ছড়া উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে সিসিকের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এইখাতে চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কী কাজ হয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। কেন এত প্রকল্পের পরও এভাবে পানি জমে যাচ্ছে তা জানা দরকার।’

ড্রেনের নেটওয়ার্ক ঠিক আছে কি না তা খোঁজ নিয়ে দেখা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পানি ড্রেন দিয়ে যেখানে গিয়ে নামার কথা সেখানে নামছে কি না তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা দূর করতে হবে।’

এর আগে জুলাইয়ের শুরুর দিকেও ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জলাবদ্ধতার জন্য নদীর পানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে উল্টো নদীর পানি শহরে ঢুকছে। তবে এবার নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। তবু জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হলো নগরবাসীকে।

এই জলাবদ্ধতার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জলাবদ্ধতার জন্য মেয়রের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজকে অনেকেই দায়ী করেন।

এ ব্যাপারে মেয়রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরিচয় জানিয়ে এসএমএস করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান ড্রেন পরিষ্কার না করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বন্যার পর আমরা ছড়াগুলো পরিচ্ছিন্নতার কাজে মনোযোগী ছিলাম। এরপরে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে আমাদের টিমগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে ড্রেনের আবর্জনাগুলো সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ড্রেনে আবর্জনা জমেছে কি না তা এখন আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব।’

ছড়া খাল উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই সব প্রকল্পের কারণে এখন আর আগের মতো নগরে পানি জমে না। তবে কালকেরটা ব্যতিক্রম।’

শনিবার রাতে সিটি মেয়রের বাসায়ও পানি ঢুকে পড়েছিল বলে জানান তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত