শাকিলা ববি, হবিগঞ্জ

০৮ মে, ২০১৬ ১৩:০০

যাদের মা নেই

মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক মধুর। মায়ের প্রতি ভালবাসা জানাতে কোন নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন নেই। তারপরেও মায়ের জন্য নেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ দিন। প্রতিবছরের মে মাসের ২য় রবিবারকে বেছে নেওয়া হয়েছে পৃথিবীর সকল মায়েদের জন্য। পৃথিবীর অকৃত্রিম ভালবাসার  নাম মা। সন্তান সন্ততির নির্ভয়ের স্থান তিনি। আমাদের সকল আবদার যেন তার কাছেই। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসা কতটুকু তা মাপ করার নেই কোন ব্যারোমিটার । অনুভূতি ছাড়া কোনভাবেই তা বুঝানো সম্ভব নয়।  কেউ কেউ মায়ের স্নেহ ভালবাসা পায় যুগের পর যুগ। আবার অনেকেই আছেন যারা জন্মের পর পরই মাকে হারিয়ে আদর স্নেহ  থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। আজ মা দিবসে পৃথিবীর সকল মা কে জানাই শুভেচ্ছা । মা দিবসে হবিগঞ্জ শিশু পরিবারের কয়েকজন শিশুর মায়ের অভাবের অনুভূতি তুলে ধরা হল।


রিয়াজকে জন্ম দেয়ার সময়ই মারা যান তার মা মাহমুদা খাতুন। মায়ে আদর ভালবাসা কেমন হয় সেই অনুভূতি নেই রিয়াজের । এমনকি মায়ের চেহারা কেমন তাও মনে নেই শিশু পরিবারের বাসিন্দা রিয়াজের।  নয়নমণি।  মায়ের নাম খুদেজা বেগম, বাবা আকাশ মিয়া। বর্তমানে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে নয়নমণি। বাবার সাথে ঝগড়া করে বিষ খেয়ে মারা যান  নয়নমণির মা খুদেজা বেগম। মা মারা যাওয়ার পর নয়নমণির লালন পালনের জন্য তার বাবা অস্বীকৃতি জানালে তার নানু ও মামা হবিগঞ্জ সরকারী শিশু পরিবারে ভর্তি করেন তাকে।  নয়নমণি বলে- যখন শিশু পরিবারে কারো মা দেখা করতে আসে তখন আমার মা এর কথা খুব মনে হয়। খুব কান্না পায়। মনে হয় আমার মা থাকলে তিনিও তো আমার সাথে দেখা করতে আসতো।  

৬য় বছরের  শিশু শাহআলম, মা বাবার ভালোবাসা কেমন হয় তা জানে না সে ।  খুব কম বয়সে  মারা যান তার বাবা মা। মায়ের বা পরিবারের আদর যতœ সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকলেও একা থাকলে মায়ের কথা মনে হয় শাহআলমের। শিশু পরিবারের কর্তৃপক্ষরা বলেন শাহআলম প্রথমে করোর সাথে মিশতো না ।একা একা থাকতো। পরবর্তীতে সবার সহযোগিতায় শিশু পরিবারের অন্য শিশুদের ভালোবাসায় তার আচরণে পরিবর্তন আসে।

মোঃ রুহুল আমিন ও আল আমিন ২ ভাই। তারা দুজনই শিশু পরিবারের নিবাসী। বড় ভাই রুহুল আমিন ৬ষ্ট শ্রেণীতে আর ছোট ভাই আল আমিন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। তারা তাদের মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলে আমার মা যেদিন মারা যায় সেদিনও আমাদের ২ ভাইকে গোসল করিয়ে নিজের হাতে ভাত খাইয়েছিলেন । এখনও ভাত খাওয়ার সময় সেই দিনের কথা মনে পড়ে। যখন কারো মা আসে তখন খুব কষ্ট হয়  মায়ের মুখটি ভেসে উঠে বার বার।

শিশু পরিবারের আরেক শিশু মামুন। মাকে যখন হারায় তখন বয়স মাত্র ৪ বছর । এর কিছুদিন পর  বাবাও মায়ের মতো চলে যান না ফেরার দেশে। স্থানীয় মেম্বারের সহযোগিতায় সরকারী শিশু পরিবারে ভর্তি হয় সে। স্কুলে যাওয়ার সময় যখন দেখি সবার মা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যান তখন খুব আফসোস হয়। মনে হয় আজ যদি আমার মা থাকতো তাহলে আমাকেও হাতে ধরে স্কুলে নিয়ে যেত। বর্তমানে মামুন নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত আছে।

সজিবের বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের অভাব অনটনে লেগেই থাকতো। এই জন্য ৮ বছর বয়সের সময় শিশু পরিবারে ভর্তি করা হয় তাকে । মাকে ছাড়া কেমন লাগে তা বুঝানো যাবেনা জানালো সজিব। মা বেঁচে আছেন ঠিকই।  কিন্তু অভাবের নিষ্ঠুর থাবা আর নিজের   সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিশু পরিবারে থাকতে হচ্ছে । শিশু পরিবারে সে ভালো খাবার , পোশাক উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মায়ের ¯েœহ, ভালবাসা, আদর সব সময় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ।

লোকমানের মা যখন মারা যান তখন তার বয়স মাত্র ৬ মাস।  মা মারা যাওয়ার পর তারা বাপ দাদা এবং বোন মিলে তাকে লালন পালন করেন । বাবা মারা যাওয়ার পর কিছুদিন বোনের বাড়িতে থাকে লোকমান। শিশু পরিবারে থাকলে কোন কষ্ট লাগে না লোকমানের কারণ এখানে এসে তার সব কষ্ট দূর হয়েছে। লোকমান জানায় মায়ের মুখ দেখতে কেমন সে ভাগ্য আমার হয়নি। মা  বাবর কবর জিয়ারত করি তখন মন খারাপ হয়ে যায়। চাচতো  কিংবা মামাতো ভাই বোন সবাইকে মা বাবর সাথে থাকতে দেখে খুব কষ্ট হয়।এই শিশু পরিবারে অনেক সহপাঠীদেরই মা আসেন তাদের সন্তানকে দেখতে আসেন। তাদের দেখলে মনে হয় আজ আমার মা বেঁচে থাকলে তিনিও এভাবে আমাকে দেখতে আসতেন। মাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে রাতে  তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। মনকে সান্ত্বনা দেই এইভাবে যে সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে এই পৃথিবী থেকে। লোকমান মিয়া ৬বছর যাবত শিশু পরিবারের বাসিন্দা । এখন সে ৮ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত আছে।

সরকারি শিশু পরিবার (বালক),হবিগঞ্জ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র পরিবারের সদস্য  ৯৫ জন আছেন যাদের অনেকেরই মা অথবা বাবা নেই। ২০০৯ সালের মে মাসের ৩১ তারিখে ৪৪ জন শিশু নিয়ে হবিগঞ্জ সরকারি শিশু পরিবারের  যাত্রা শুরু হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত