নিজস্ব প্রতিবেদক

২৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ০১:০৮

জৈন্তাপুরে ওয়াজে সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে

জৈন্তাপুরে ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। সোমবার রাতে সংঘর্ষকালে অন্তত ৫০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- জৈন্তাপুরে কওমী মাদ্রাসা অনুসারীদের আধিক্য রয়েছে। গত কয়েকবছর ধরে উপজেলার কিছু এলাকা আটরশী পীরের কিছু অনুসারী তৈরি হন। এ  দু'পক্ষের মধ্যে অনেকদিন থেকে মতানৈক্য ও বিরোধ চলে আসছে।

সোমবার রাতে জৈন্তাপুর উপজেলার বাংলাবাজার আমবাড়ি এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে আটরশী পীরের অনুসারীরা। আয়োজকদের মাজারপূজারী দাবি করে এই ওয়াজ মাহফিল বন্ধের দাবি জানায় কওমীপন্থী স্থানীয় হরিপুর মাদ্রাসার ছাত্ররা।

এলাকার জনপ্রতিনিধি, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ও প্রতক্ষ্যদর্শী সাথে আলাপকালে জানা যায়- ওয়াজ চলাকালে রাত ১০টায় প্রধান অতিথির বক্তব্যকালে হরিপুর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস আব্দুস ছালামের সাথে আয়োজকদের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে পূর্ব থেকে অবস্থানে থাকা হরিপুর মাদ্রাসার অর্ধশতাধিক ছাত্র ও শিক্ষক ওয়াজ বন্ধের চেষ্টা চালায়। এতে উভয় পক্ষ সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে। এসময় ঘটনাস্থলে নিহত হন হরিপুর মাদ্রাসার ছাত্র মুজ্জাম্মিল হোসেন।

 অপরদিকে ঘটনার সংবাদ পেয়ে হরিপুর এলাকায় বিভিন্ন মসজিদে মাইকযোগে ওয়াজে হরিপুর মাদ্রাসার শিক্ষক সহ ছাত্র নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করে সবাইকে সহযোগীতার করার আহবান জানানো হয়। তাৎক্ষণিক ভাবে গোটা উপজেলা জুড়ে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদ পেয়ে উপজেলা বিভিন্ন কৌওমী মাদ্রাসার মুসল্লিরা হরিপুর, দরবস্ত থেকে গাড়ী যোগে দেশিয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘটনাস্থলে আসে। এসময় আমবাড়ী এলাকার অর্ধশতাধিক বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নি সংযোগ করা হয়। নিমিষেই অগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় এসব ঘরবাড়ি। জীবন বাঁচাতে দৌড়ঝাপ করতে গিয়ে সাধারণ এলাকাবাসী অনেকেও এসময় আহত হন।

যদিও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরীতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলেন মাদরাসাতুল উলুম দারুল হাদিস হরিপুর বাজার মাদরাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পরে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনকারীরা।

এসময় মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন, জৈন্তাপুর উপজেলার ১নং লক্ষিপুর আমবাড়ি গ্রামের জামে মসজিদে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়েছিলেন মাদরাসাতুল উলুম দারুল হাদিস হরিপুর বাজার মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মাওলানা আব্দুস সালাম। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি মসজিদে উপস্থিত হন। এ সময় বক্তব্য রাখছিলেন মাওলানা গাজী সোলায়মান হোসেন। তার বক্তব্য কোরআন বিরোধী হওয়ায় মাওলানা আব্দুস সালাম আপত্তি করেন। সাথে সাথে সন্ত্রাসীরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় হরিপুর মাদরাসার ২০/২৫ জন ছাত্র তাকে উদ্ধার করতে গেলে  মুজম্মিল আলী নিহত। হামলায় মাদ্রাসার আরো ১৩ জন ছাত্র আহত হন বলে দাবি তাঁর।

এ ব্যাপারে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনকারী আটরশী পীরের অনুসারীদের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জৈন্তাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের ওয়াজ মাহফিল নিয়ে স্থানীয় কৌওমী মাদ্রাসার বিভিন্ন মাতালম্বীদের মধ্যে মতপার্থক্য চলে আসছে। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একাধিকবার বৈঠক হলেও নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হওয়াতে জেলা প্রশাসকের নিকট বিষয়টি হস্তান্তর করা হয়। সোমবার একটি অংশ ওয়াজের আয়োজন করা হলে অপর অংশের লোকজন ওয়াজ মাহফিলে আক্রমণ করলে এ সংঘর্ষের সুত্রপাত ঘটে। এসময় আমার বাড়িতেও তারা হামলা ও অগ্নি সংযোগ করে।

এবিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌরীন করিম জানান-  জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেওয়া হয়। ঘটনাস্থল আমবাড়ী গ্রামে তাৎক্ষনিক ভাবে মেডিকেল টিম প্রেরণ করা হয়, হতহতদের নগদ অর্থ সাহায্য এবং তাদের মধ্যে কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরন করা হয়েছে।

ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান, এডিসি জেনারেল শহিদুল ইসলাম, জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌরীন করিম, সহকারি কমিশনার(ভূমি) মুনতাসির হাসান পলাশ, জৈন্তাপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ খাঁন মোঃ মঈনুল জাকির, অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আনোয়ার জাহিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

তবে এ ব্যাপারে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। ইতিমধ্যে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০টি পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৩ হাজার টাকা অনুদান ও খাবার বিতরণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রদান করা হয়েছে।

ঘটনা খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহিদুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

এবিষয়ে জেলা প্রাশসক রাহত আনোয়ার সাংবাদিকদের জানান, এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা স্বার্থে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এলাকার পরিবেশ যাতে আর কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয় সে জন্য স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি সাথে আলাপ করে বিষয়টি মূল কারন উদঘাটনের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এঘটনায় আমবাড়ী এলাকার বেশ কিছু ঘরবাড়ী পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং জান মালের ব্যপক ক্ষতি সাধিত হওয়ার কারনে প্রাথমিক ভাবে একটি তালিকা প্রস্তুত করে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে আর্থিক সহায়তা, কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরন করা হয়েছে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আমরা সবাই ছুটে এসে ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়িয়েছি এছাড়া সরকারের পক্ষ হতে সকল ধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ঘটনার সাথে যে কেউ জড়িত থাকুক না কেন থাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান।

জৈন্তাপুর থানার (ওসি) খান মো. মঈনুল জাকির জানান, এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি বা কাউকে আটক করা হয়নি। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে। এলাকায় বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত