মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

০৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০১:৩৭

৫ হাজার মিলিয়ন ডলারের বাজারে নেই বাংলাদেশ

বিশ্বে দিন দিন বাড়ছে সাপের বিষের চাহিদা। বিষের পাশাপাশি সাপের চামড়া এবং মাংসের বাজার বিশ্বব্যাপী। সাপের চামড়া বাজার শুধু এশিয়াতেই ৬শ মিলিয়ন ডলারের, মাংসের বাজার ও প্রায় সমপর্যায়ের।

অন্য দিকে সাপের বিষের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ডলারের তবে গবেষণা প্রতিষ্টান TMR জানিয়ছে ২০২৫ সালে এই বাজার ২ হাজার ৯ শত ৪৬ মিলিয়ন ডলারে পৌছাবে । কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের অভাবে বিশাল এই আন্তর্জাতিক বাজারে এখনও ঢুকতে পারেনি বাংলাদেশ ।

বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে সাপের খামারের কোন অনুমতি দেওয়া হয় না। উপরুন্তু বাংলাদেশে অবহেলা আর সচেতনতার অভাবে যত্রতত্র সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে। এতে যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য হারাচ্ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে মিলিয়ন ডলারের আয়ের সম্ভাবনা। অথচ এটি হতে পারতো বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের অন্যতম বড় মাধ্যম।

টান্সপারেন্সি মার্কেট রিসার্জ (টিএমআর)-এর তথ্য মতে , দিন দিন বিশ্বে সাপের কাটা রোগীদের এন্টি বেনাম তৈরীসহ বিভিন্ন ওষুধ তৈরীতে বাড়ছে সাপের বিষের ব্যবহার। ২০১৬ সালে সাপের বিষের আন্তর্জাতিক বাজার ১ হাজার ৬ শ ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল এবং ২০২৫ সালে তা পৌছাবে ২০২৫ সালে ২ হাজার ৯ শত ৪৬ মিলিয়ন ডলারে। শুধু সাপের বিষ নয় সাপের চামড়ার মার্কেট  শুধু এশিয়াতেই ৬শ ২৫ মিলিয়ন ডলারের এবং চামড়ার থেকেও বড় মার্কেট সাপের মাংসের। সাপের চামড়ার গ্রাহক সাধারণ আরব শেখ এবং শৌখিন মানুষ। সরকারী সিন্ধান না আসলেও চোরাকারবারীরা ঠিকই চোরাই পথে প্রতি বছর সাপের বড় বড় চালান চিন থাইল্যান্ড, কুরিয়া, সিঙ্গাপুর সহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রথম সাপের খামারের পরীক্ষামুলক উদ্যোগ নেয়া হয় ঠাকুরগাঁয়ের হরিপুরের তোতা মিয়াকে দিয়ে কিন্তু ফার্ম গঠনের ২ বছরের মাথায় তোতা মিয়া সাপের কামড়ে মারা গেলে সরকার খামারিরদের নিরাপত্তার কথা ভেবে  পিছিয়ে আসে। তবে বর্তমানে যে শিক্ষিত যুবকরা নিজ উদ্যগোগে খামার করছেন তারা বলছেন তোতা মিয়ার খামারের যে অবকাঠামো দরকার তা তার ছিলনা। তিনি বিষধর যেনেও গলায় একটা সাপ পেছিয়ে রাখতেন। বিষদাঁত ভেঙে সাপকে গলায় রাখা যায় কিন্তু ১৫ দিন পর আবার সেই বিষদাঁত গজিয়ে উঠে সেই ধারনা তোতা মিয়ার ছিল না এবং কামড় খাওয়ার পরেও যথাযথ চিকিৎসা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশের সাপের বিষসহ মাংস এবং চামড়ার গুণগত মান অনেক ভাল তাই এর চাহিদাও বিশ্বব্যাপি। সাপের খামার করার জন্য বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা বিশ্বের অনন্যানো দেশের থেকে অনেকগুন ভালো। একশত সাপের খামার তৈরীতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২/৩ লক্ষ টাকা হলে সম্ভব আর একই পরিমাপের ফার্ম অন্যান্য দেশে করতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন । শুধু একটি রাসেল ভাইপার সাপ থেকে বছরে ৬ লাখ টাকার বিষ বিক্রি করা সম্ভব।

 আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সাপের বিষ মাত্র ১ গ্রামের দাম সাপের প্রজাতি বিশেষে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা।  শুধু বিষ নয় আন্তর্জাতিক বাজারে সাপের চামড়া , সাপের মাংসের দামও অনেক । এত সম্ভাবনা থাকার পরেও বাংলাদেশে সাপের খামারের অনুমতি দিচ্ছে না সরকার । যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ডসহ আরো আরো বেশ কয়েকটি দেশ সাপের বিষ বাজারজাত করে তাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।  

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাপের খামারের অনুমতি দিলে জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে মোটা দাগে ভুমিকা রাখবে এই সেক্টর। আমাদের বিশাল সাগর কে কাজে লাগিয়ে যে ব্লুইকোনমির কথা ভাবছে সরকার তাতেও গতি এনে দিতে পারে সাপের বিষ। সাগরের বিষাক্ত সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা গেলে তা মাছের উৎপাদনের আয়কেও ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাপের খামার গড়ে তুলেছেন কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ। তারা জানালেন সাপের প্রতি ভালবাসা থেকেই তারা খামার তৈরি করেছেন কারন মানুষ সাপ দেখলেই মেরে ফেলে।

তাদের একজন রাজবাড়ী্র রনজু মল্লিক। তিনি জানান, সাপের নিরাপত্তা এবং তাদের প্রতি ভালবাসা থেকেই আমার এই খামার। আমরা সরকারি অনুমতি পেলে নিজে যেমন উন্নয়ন করাতে সক্ষম হব তেমনি অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে। অবহেলিত এই খাতকে পরিচালনা করতে পারলে দেশের অর্থনীতির চাকায় গতি আসবে ও বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নতুন আরেকটা উন্নয়নের অধ্যায় তৈরি করবে বলে আমার দৃর বিশ্বাস।

রাজশাহী এলাকায় মানুষের হাতে প্রচুর সাপ মারা যায় প্রতি বছর , এমন কিছু সাপ মানুষ কাছ থেকে উদ্ধ্বার করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন বোরহান বিশ্বাস রোমন। তিনি জানান, আমার এলাকায় কোন বনাঞ্চল নেই যেখানে সাপ অবমুক্ত করা যায় তাই মানুষ কাজ থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছেই রাখছি । তিনি আরো জানান, এই সাপগুলো লালন পালনে যে অর্থনৈতিক কষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তিত । ছেড়ে দেবার জায়গা নেই এবং মানুষ এদের পেলেই মেরে পেলবে।

অনেক দেশ ইতিমধ্যে সফল হয়েছে সাপের ফার্মিং করে। সব বিষয় বিবেচনা করে যদি অনুমতি দেওয়া হয় আমরা সফল হব কারন, সাপের বিষ, চামড়া এবং সাপের মাংসের কোয়ালিটি আমাদের দেশে খুবই ভাল । তবে খামার করার আগে অবশ্যই যতাযত ট্রেনিং নিতে হবে এবং শিক্ষিত তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

তবে পরিবেশবাদী এবং প্রানীবিদদের মতে সঠিক এবং কঠোর নীতিমালা না থাকলে সাপের খামারের কারনে প্রকৃতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তাদের একজন আদান আজাদ আসিফ। তিনি জানান, সাপের খামার খুব বিপদ জনক এবং সেই সাথে লাভজনক তাই খামারের অনুমতি যেমন দেওয়া উচিৎ  তেমনি সঠিক প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সাপ পালন ,নিজের নিরাপত্তা এবং বিষ সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণের যতাযত প্রশিক্ষন দিতে হবে সেই সাথে আবার প্রকৃতি থেকে সাপ না ধরার কঠোর নীতিমালা থাকতে হবে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপ আমদানী করে খামার করা যাতে পারে।  

এ বিষয়ে রাবি’র জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ আবু রেজা জানান, আমি ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি বাংলাদেশে যে এন্টি ভেনাম বাইরে থেকে আসে তা ৫০% অকার্যকর এর ফলে আমাদের দেশে রোগীদের চিকিৎসা করে বেশীর ভাগ সময় সফলতা আসে না। আমাদের দেশের সাপের বিষের মান অনেক অনেক ভাল যা থেকে একসাথে আমরা যেমন রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি তেমনি দেশে সাপে কাটা রোগীদের জন্যও আশীর্বাদ হবে। ফার্মের অনুমতি দিলে সাপের চোরাচালান যেমন বন্ধ হবে তেমনি রক্ষা পাবে পরিবেশ কারন ফার্ম থেকে প্রচুর সাপ জন্ম নেবে এবং প্রকৃতিতেও সাপ পেলে মানুষ তা মারতে যাবেনা কারণ এর গুরুত্ব বুঝতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন। শুধু আমদানি নয় রপ্তানির বাজারও বের করতে হবে। লেদার, সিরামিক , টেক্সটাইলের পাশাপাশি এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হবে নিশ্চই। তবে নীতিমালা প্রনয়ন করতে হবে এবং তা কার্যকর রাখতে হবে কারন একেত বিষধর তার উপর পরিবেশের উপর আঘাত আসে কিনা তা দেখাও গ্রুরুত্বপূর্ন।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রন ইউনিটের পরিচালক মিহির কুমার দো জানান, বর্তমানে সাপ পালন বণ্যপ্রানী আইনে অপরাধ তবে ইতিমধ্যে বনবিভাগের পক্ষ থেকে একটি খসরা নীতিমালা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। যদি তা কার্যকর হয় তবে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার বাধ্যবাধকতা সহকারে বনবিভাগ সাপের খামারের অনুমতি দেবে। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত