শাকিলা ববি

২৪ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ১৬:৫৩

ইচ্ছা পূরণ আবাসনে বদলে গেছে ১৩ শিশুর জীবন

সকালে ঘুম থেকে উঠেই যে শিশুটি ভিক্ষা করতে যেত সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে, সে এখন প্রতিদিন নাস্তা করে স্কুলে যায়। হাতে ভিক্ষার থালা নয়, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করছে। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম করে পড়তে বসে। নাচ, গান, আবৃত্তি, সবই করছে। বলছিলাম কানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির ছাত্র সাগর আহমেদ সৃজনের কথা।

রেলস্টেশন কলাবাগান কলোনির বাসিন্দা সৃজন। বয়স সাত কি আট হবে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে ভিক্ষা করাই ছিল তার কাজ। বাবা বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে ছোট। মায়ের কাজের উপার্জন আর সৃজনের ভিক্ষার টাকায় চলত তাদের সংসার।

তবে সৃজন আর এখন ভিক্ষা করে না। সে আর তার বড় বোন সুমাইয়া এখন ইচ্ছা পূরণ আবাসনের বাসিন্দা। কানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সৃজন শিশু শ্রেণিতে আর তার বোন সুমাইয়া (১০) প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

দাঁত মাজা, সময় মতো গোসল করা, খাওয়া, স্কুলে যাওয়া একসময় স্বপ্নের মত ছিল তাদের কাছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে ‘ইচ্ছা পূরণ আবাসন’। সুন্দর জীবনযাপন করতে পেরে বেজায় খুশি ভাই-বোন।

সৃজন বলে, 'স্টেশনে যাইতে পারি না ট্রেনের উপর দৌড়াইতে পারি না তাই প্রথম দুই-তিন দিন খুব খারাপ লাগছে এখানে থাকতে। এখন ভালা লাগে। সকালে ঘুম থেইক্কা উইট্টা দাঁত মাজি, নাস্তা খাই, স্কুলে যাই। এখানের ভাইয়া-আপুরা খুব ভালা। আমরারে অনেক আদর করে। আমরারে নাচ গান শেখায়।'

সৃজন বলে, 'আমি লেখাপড়া শিখে আগে ভাল মানুষ হইমু পরে বিমান চালাইমু।'

সৃজনের মত সিলেট রেলস্টেশন কলোনির ১৩ জন শিশুকে পুনর্বাসন করা হয়েছে ইচ্ছা পূরণ আবাসনে। এই আবাসনের প্রতিটি শিশুই ভিক্ষাবৃত্তি, গৃহকর্মী, টোকাইয়ের কাজ করতো। এখন তারা সবাই কানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়নরত রয়েছে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে প্রায় ৫ বছর যাবত কাজ করছে সামাজিক সংগঠন ‘ইচ্ছা পূরণ’। এরই ধারাবাহিকতায় আড়াই বছর যাবত সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে ভ্রাম্যমাণ পাঠশালার মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে আসছে তারা। সেই স্কুলের পাশাপাশি এখন অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয় 'ইচ্ছা পূরণ আবাসন' প্রকল্পের।

‘ঝরা পাতাকে তুলে ধরি’ এই স্লোগান ধারণ করে ২৭ জানুয়ারি ইচ্ছা পূরণ আবাসনের উদ্বোধন হয়। নগরের কানিশাইল এলাকায় দুই রুম ভাড়া করে শুরু হয় এই আবাসনের কার্যক্রম। ইচ্ছা পূরণ পাঠশালার ১৩ জন শিশুকে নিয়ে শুরু করা হয়েছে ইচ্ছা পূরণ আবাসনের প্রথম ধাপের কাজ। এই ১৩ জন শিশুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়া, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ তাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে ইচ্ছা পূরণ পরিবার।

এই শিশুদের দেখাশুনা করার জন্য রয়েছেন রিক্তা নামের একজন সেবিকা। ইচ্ছা পূরণের সদস্যদেরও প্রতিদিন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কার্যক্রম বণ্টন করে দেওয়া আছে।

প্রতি শুক্রবার এই শিশুদের পরিবারের সদস্যরা আসেন তাদের সাথে দেখা করতে। এছাড়াও এখানে বসবাসরত ১৩ শিশুর মধ্যে বেশিরভাগই আপন ভাই-বোন। সেজন্য তারা পরিবারের কমতি অনুভব করে না।

ইচ্ছা পূরণ আবাসনের আরেক বাসিন্দা শামিম (১১) ও শারমিন (৮)। তারা দুজন ভাই-বোন। বাবা মানিক মিয়া অসুস্থ তারপরও বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে সংসার চালান। এখানে আসার আগে শামিমও ভাঙাড়ির জিনিসপত্র কুঁড়িয়ে উপার্জন করতো। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তারা দুজন ইচ্ছা পূরণ আবাসনে থাকায় পরিবারের সদস্যরা অনেক খুশি।

শামিম বলে, 'এখন অনেক ভাল আছি। আমার এখানে লেখাপড়া করায়, ভাল খাবার খাওয়ায় আমার আব্বা আম্মাও অনেক খুশি।'

সাদিকা (১১) আর আফিয়া (৯) দুই বোন। ছয় মাস হয়েছে তারা সিলেট এসেছে। পরিবারের সাথে বড়লেখার কাঠালতলী এলাকায় বসবাস ছিল তাদের। এলাকার একটি খুনের ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার পর থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরে সাদিকা। তাই ডাক্তার পরামর্শ দেন ওই এলাকা ছেড়ে অকে নিয়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার।

এজন্য তার বাবা-মা তাদেরকে নিয়ে চলে আসেন সিলেটে। রেলওয়ে কলোনিতে বাসা ভাড়া করেন। এখানে এসে কোনো কাজের সুবিধা করতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন আফিয়ার বাবা। তাই ইচ্ছা পূরণের সদস্যরা যখন তাদের দায়িত্ব নিতে চাইল তখন খুশি মনে সম্মতি দেয় তার পরিবার। সাদিকার মনোবাসনা লেখাপড়া করে ডাক্তার হওয়ার। তাই লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী সে।

তাদের তত্ত্বাবধায়ক রিক্তা আক্তার ঝুমা বলেন, এই শিশুদের জন্য কাজ করে মনে অনেক শান্তি পাই। বেশির ভাগ বাচ্চারাই ছোট তাই বিছানা ভিজায়, কথা শুনতে চায় না। আমিও তাদের সাথে বড় বোনের মত থাকি। রান্না করে খাওয়াই, গোসল করাই, স্কুলের জন্য রেডি করে দেই। তাদের অভিযোগ আবদার শুনি। ইচ্ছে পূরণের ভাই-আপারা আসলে কথা বলে তাদের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করি।

ইচ্ছা পূরণ সংগঠনের সদস্য মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন যাবত আমরা সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে এই শিশুদের ইচ্ছা পূরণ পাঠশালায় নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছি। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেই আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকেই এই আবাসন কার্যক্রম শুরু করেছি। সংগঠনের ফান্ডের টাকা ও কাছের বন্ধু-বান্ধব, স্বজনদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে তাদের ইচ্ছা পূরণ করছি।

তিনি বলেন, এই আবাসন কার্যক্রম শুরু করতে অনেক বাধারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে সাহায্যও করেছেন অনেকেই। বিশেষ ভাবে সিলেট সিটি করপোরেশন, কানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এই এলাকার জনপ্রতিনিধি ও মুরব্বিরা অনেক সাহায্য করেছেন। ভবিষ্যতে সবার সহযোগিতায় এই কার্যক্রম আমরা চলমান রাখতে চাই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত