দেবকল্যাণ ধর বাপন

২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০১:৩৪

সিলেট বিভাগের ‘হটস্পট’ হবিগঞ্জ, শঙ্কা বাড়াচ্ছে সুনামগঞ্জও

দেশে দিন দিন বেড়েই চলছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। বর্তমানে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ছয়হাজার ছুঁই ছুঁই। সেই সাথে সংক্রমণ বাড়ছে সিলেটেও। সোমবারই সিলেট বিভাগে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা একশ' পেরিয়েছে। বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে হবিগঞ্জ জেলায়। তাই এই জেলা হয়ে উঠেছে বিভাগের ‘হটস্পট’। একইভাবে সুনামগঞ্জেও বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। সাথে শঙ্কাও।

সোমবার (২৭ এপ্রিল) পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১০১ জন। এর মধ্যে ৪৮ জনই হবিগঞ্জের। সুনামগঞ্জে শনাক্ত হয়েছেন ২৬ জন। যার মধ্যে সোমবার একদিনেই এই জেলায় ১১ জন শনাক্ত হয়েছেন। বিভাগের অন্য দুই জেলা সিলেটে ১৪ জন ও মৌলভীবাজারে ১৩ জন শনাক্ত হয়েছেন।

তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এর ২৮ দিন পর ৫ এপ্রিল সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের এক সহকারি অধ্যাপকের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয় প্রথম বারের মতো। এর ১৪ দিন পর ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৮ জন। যার চারজনই সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলার।

বিজ্ঞাপন



তবে সিলেটের চিত্র পাল্টাতে শুরু করে এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে। সেদিন একদিনে সিলেটে ১০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। যাদের সকলেই সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার। এর আগে সিলেট বিভাগের কোথাও এতো সংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়নি। কিন্তু সেদিন বিভাগের মোট আক্রান্তের সংখ্যাকেও ছাপিয়ে যায় হবিগঞ্জ।

হবিগঞ্জে আক্রান্তদের মধ্যে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক, সেবিকাসহ অনেক স্বাস্থ্যকর্মীও রয়েছেন। এরইমধ্যে জেলার লাখাই ও চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লকডাউন করা হয়েছে। রোববার রাতে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালও লকডাউন ঘোষণা করা হয়।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যে জানা যায়, জেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৯ এপ্রিল। নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে আসা ওই ব্যক্তি পেশায় একজন ট্রাকচালক। এরপর বেশ কিছুদিন আর কেউ আক্রান্ত হননি। কিন্তু ২০ এপ্রিল একদিনেই লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক ও সেবিকা (নার্স) সহ মোট ১০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হন। পরদিন ২১ এপ্রিল লাখাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরও একজন সেবিকা (নার্স) আক্রান্ত হন। এত সংখ্যক আক্রান্ত হওয়ায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ২১ এপ্রিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

তবে এতদিন সদর উপজেলায় কোনো রোগী শনাক্ত না হলেও সর্বশেষ গেল ২৫ এপ্রিল একদিনেই ২০ জন আক্রান্ত হন। যাদের ১৫ জনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাকি ১১ জন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর আধুনিক হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, সেবিকা, ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও এম্বুলেন্স চালক। আর বাকি ৪ জন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ আরও ২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। অপরজন একই অফিসের নাজির।

সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল রাতে একজন সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) আক্রান্ত হন বলে জানানো হয়। সবমিলিয়ে জেলায় চিকিৎসক, সেবিকা, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ ২২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত।

বিজ্ঞাপন



এদিকে সোমবার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) করোনাভাইরাস নিয়ে দেয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে- নারায়ণগঞ্জ ৬৯৯, গাজীপুর ৩১৫, কিশোরগঞ্জ ১৯১, নরসিংদী ১৪২, ময়মনসিংহ ১০৮, মুন্সীগঞ্জ ৭৮, চট্টগ্রাম ৫৬, গোপালগঞ্জ ৫০, কুমিল্লা ৪২ ও জামালপুর ৪৫ শনাক্ত হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার কারণ হচ্ছে মানুষের অসচেতনতা। মানুষ লকডাউন মানছে না। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব ঘটনা সংক্রমণের শঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে। বাজারেও শত শত মানুষ সমবেত হচ্ছেন। সবকিছুই যদি স্বাভাবিকভাবে চলে তাহলে লকডাউন করার প্রয়োজন কী?

হবিগঞ্জে সংক্রমণ বেশি হওয়ায় এবং সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় সিলেট বিভাগের মধ্যে এ জেলাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, হবিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার বহু নারী-পুরুষ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কাজ করেন। সেখানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর প্রতিদিন দলে দলে এসব শ্রমিক হবিগঞ্জ নিজ বাসস্থানে এসেছেন। এরা হোম কোয়ারেন্টিন না মানায় এর খেসারত এখন দিতে হচ্ছে এখন পুরো সিলেট বিভাগকে।


বিজ্ঞাপন



এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. আনিসুর রহমান সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘সিলেটের জন্য করোনার হটস্পট হবিগঞ্জ এটা এখন বলাই যায়। কেনো না ঢাকা জেলাকে যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয় ঠিক সে সময় ঢাকায় বা নারায়ণগঞ্জে কর্মরত হবিগঞ্জের অনেক স্থায়ী বাসিন্দারা তাদের পরিবারসহ নিজ নিজ বাড়িতে চলে আসেন। যাদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। কিন্তু তখন সিলেট বিভাগ বা তার আশপাশের জেলাগুলো লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। তারপরও আমরা তাদের অনেককেই ফিরিয়ে দেই অথবা কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করি।’

এছাড়া যারা বিভিন্ন পথ হয়ে হবিগঞ্জে বা তার আশপাশের এলাকায় ঢুকে পড়েছে তাদেরকে সে সময় শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা বিভিন্ন উপজেলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। একইসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন ইসলামী চিন্তাবিদের জানাজায় হবিগঞ্জ থেকে প্রচুর লোকজন সেখানে গিয়েছিলেন। যারা মূলপথ এড়িয়ে বিভিন্ন ফাঁড়ি পথে সেখানে গিয়েছিলেন ও পরবর্তীতে আবার নিজ নিজ গ্রামে ফেরত এসেছেন। এছাড়া গত কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে একটি ট্রেন সিলেটে প্রবেশ করে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদিও যাত্রী আনার বিষটি অস্বীকার করছেন তবে আমাদের মনে হয় এই ট্রেনে কিছু যাত্রী ছিলো যারা সিলেটে প্রবেশের পূর্বে বিভিন্ন এলাকায় নেমে পড়েছেন। মূলত এসব কারণেই হবিগঞ্জে সংক্রমণের হার বেশি হচ্ছে ও দিনকেদিন বাড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যাদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি তাদের মধ্যে যারা করোনা পজিটিভ তাদের সকলেরই ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বা তাদের সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া লকডাউনের পর সিলেটের বাইরে থেকে আসা অনেকেই তথ্য লুকচ্ছেন এবং অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারণ তাদের অনেকেই জানে না যে তিনি নিজে সংক্রমিত। ফলে অবাধে চলাফেরা করছেন। তাই অতিসত্বর আমাদের সকলে সচেতন হতে হবে। না হলে বিপদ বাড়বে বৈকি কমবে না।’।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত