হুমায়ুন আজম রেওয়াজ

০৯ জুন, ২০১৬ ১৪:২৮

শুনি, বন পাহাড়ে জলধ্বনি

মোর গাঁয়েরও সীমানায় পাহাড়ের ওপারে, নিশীথ রাত্রে প্রতিধ্বনি শুনি ... 


সাগরতীরে জন্ম বলেই হয়তো পাহাড় আমার আশৈশব রহস্যলোক। সাগর বুঝি একটু চেনা ক্যানভাস! সন্দ্বীপ চ্যানেল পেরিয়ে আসতেই দূরের সীতাকুণ্ড পাহাড়ের নীলাভ রেখা কি ভীষণ টানত আমায় তা লিখে  বোঝানো মুশকিল। দৈনন্দিনতায় ডুবে কখনো সেই রহস্যলোকের চাবি খুঁজবার উদ্যমটুকু মেলেনি। অভিযাত্রীর  বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি তাই লুপ্ত স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন। ঘোরাঘুরির গল্পগুলো বনভোজনের ছবির চাইতে আরো উদ্দাম আর নির্মোহ আবিষ্কারের নির্মল আনন্দের খনি। এবারের গন্তব্য মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক ছুঁয়ে  হাম হাম জলপ্রপাত।   


দাওয়াত এল ইথারে ...  অভিযাত্রীর বন্ধুদের সাথে ঘরের বাইরে দুপা মেলানোটা বরাবরের মতই আনন্দময় ভ্রমণ এবং রোমাঞ্চের হাতছানি। তাই আলগোছে কান পেতে রাখি আর ক্যালেন্ডারের সাথে সমীকরণ মেলাই বরাবর। ০২ জুন, বৃহস্পতিবার যাত্রা শুরু শুনে পিছিয়ে গিয়েছিলাম, পরে শুনলাম শুক্রবার সকালে রওনা হবে সবাই। দ্বিধা ছিল একটাই, ফেসবুক ইভেন্ট পেইজ এ ট্র্যাকিং এর প্রস্তুতির তালিকায় তাবু গোত্রের বিষয়াদির উল্লেখ । এতে একটু থমকে গিয়েছিলাম অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা কোন বাধা হতে পারেনি। আগের রাতেই রংপুর থেকে ফেরার ক্লান্তি মুছে তাই টানটান উত্তেজনায় বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস শেষ করেই ব্যাগ গুছিয়ে পথে নেমে পড়লাম। অবশ্য এ উত্তেজনার কিঞ্চিৎ মাশুল ঝিমিয়ে বসে দিতে হয়েছে। রাতে অগত্যা মুসাফির হয়ে গেলাম ফয়সাল ভাইয়ের ডেরায়। প্রত্যুষে যথাসময়ে হাজির হলাম কমলাপুর রেল স্টেশনে। 
   


পারাবত এ পথ পাড়ি ...  বেগ ভাই, নিশাত আপু, কমিটি ইউসুফ, ছোট বাবু, মুক্তা, নিঝু, শিল্পী, ওয়াসিফা, দস্যু রত্না সবাই হাজির।  হাফিজ ভাই কে বিদায় দিতে এসে দলে ভিড়ে গেল মামুন। আমি আর ফয়সাল ভাই মিলে ১৩ সদস্যের লাকি টিম! ট্রেন ছাড়ার সময় ফোন এল শিউলির কাছ থেকে। শিউলিকে ভেংচি কেটে পারাবত এক্সপ্রেস স্টেশন ছাড়ল। এবারের সফরে বেশ ভুগিয়েছে এই ট্রেন বাহাদুর। ট্রেন যাত্রায় বিশেষ কোন ঘটনা ঘটেনি। একই বগিতে সিট না পেয়ে ২টি সিট ছেড়ে দিলাম আমরা জনস্বার্থে। বাড়তি উপদ্রব মামুনের টিকেট তো কাটাই হয়নি !!! অগত্যা ১০ সিটে তের জন ঝাঁকিয়ে  বসলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে ট্রেন কিছুটা ফাকা হল। এই সুযোগে সকালের নাস্তাপর্ব সেরে ফেললাম। দুষ্ট মামুন কোন এক স্টেশন থেকে গোটাকয় ঢেউয়া নিয়ে এল। পথিমধ্যে এক চানাচুরওয়ালার কাছ থেকে লবণ মরিচ ধার করে ভর্তা পরিবেশন করা হল! সাড়ে এগারোটা নাগাদ শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।    



কুটুমবাড়িতে খানাপিনা... এই কাঠফাটা রোদ্দুরে পথে নামার আগে দুমুঠো খেয়ে নেয়াই উত্তম বিবেচনা করে পা চালালাম কুটুমবাড়ির দিকে। বাঁশ কাঠ দিয়ে সাজানো দোতলা ছিমছাম হোটেলটি পছন্দ হয়েছে বেশ।  পরবর্তী দুদিন  এমন পরিপাটি পরিবেশে খাবার জুটবেনা, তাই মোটামুটি ভরপেট খেয়ে নিলাম সবাই।  ইউসুফ (কমিটি)  এরই মধ্যে শুকনো খাবারের ছোট ছোট পুটলি (এয়ারটাইট পলিথিন প্যাক) ধরিয়ে দিল সবাইকে।  শুরু হল পথচলা। সিএনজি করে প্রথম গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।   

পায়ে পায়ে পাহাড়ি পথে ...    সার বেঁধে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। বেগ ভাইয়ের বাণী –নীরব থাকেন আর জঙ্গলের শব্দ শোনেন। কর্ণকুহর হতে নগরের কোলাহল মুছে ফেলতে সময় লাগল। যতই গভীরে ঢুকছি লোকালয়ের কলরব মৃদু হয়ে মিলিয়ে গেল, আর তখন ঝিঁঝিঁপোকার গান আর নানান পাখির কিচিরমিচিরে যেন চারপাশ ভরে ঊঠল। কোথাও আলো আধারি মিলেমিশে একাকার।  কখনো ডেকে ওঠে তক্ষক। চিলড্রেন অব দি নিউ ফরেস্ট বইয়ে পড়েছিলাম তাকানো আর দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। এ কথার মানে বুঝতে চাইলাম আরো একবার। কম্পিউটারের ওয়ালপেপার এর চেয়েও কম উজ্জ্বল এ সবুজ বনানী কিন্তু এতো বড় ক্যানভাস যে নিজেকে না হারানোর উপায় নেই! ঘন বন যে কত কিছু বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পলকেই তা বুঝে ফেলা অসম্ভব। অতএব মনে মনে জপে নিলাম, নীরব হও, জিহ্বা ভিন্ন বাকি ইন্দ্রিয়সমূহ সজাগ এবং সজীব রাখ। জিহ্বার অন্য কাজটি অবশ্য থেমে ছিলনা একেবারেই। বনের ভেতরেই কুড়িয়ে পাওয়া বনকাঠাল, কাঁঠাল, আনারস, লেবুর স্বাদ নিয়েছি একটু পরপরই। আরো কিছু বাদ পড়ল বোধকরি।    লাউয়াছড়া ঘুরে বেরিয়ে পড়লাম রেললাইন ধরে। মাঝপথেই কোরবান হল মামুনের দুরন্তপনার শিকার গাছপাকা কাঁঠালটি। রেললাইনের দুধারে থানকুনির সমারোহ দেখে চকিত সিদ্ধান্ত হল থানকুনি পাতা খাওয়ার। তোলাও হল সেমত কিন্তু পরে আর রান্নার ফুসরত মেলেনি। এই প্রাকৃতিক খাবারের ব্যাপারে আমাদের (বিশেষ করে আমার এবং বাবুর) সার্বক্ষণিক উৎসাহ যুগিয়েছেন বিয়ার গ্রিলস! ডিসকভারি চ্যানেলের প্রোগ্রামটির ডাবিং সংস্করণের বেশ কিছু ডামি একটু পরপরই পরিবেশিত হয়েছে আমাদের দুজনের সৌজন্যে ! নেটওয়ার্কের বাইরে এমন লাইভ টেলিকাস্ট (হোকনা বানোয়াট!) কিছুটা বিনোদনের খোরাকতো অবশ্যই! সুযোগ বুঝে নিজেদের প্রশংসা করে নিলাম !!!      



হঠাৎ  পাওয়া বাহন ...  রেললাইন ধরে যখন সড়কপথে উঠে এলাম তখনো সূর্যের তেজ মরেনি একেবারেই। ঘেমে ক্লান্ত সবাই, ঠিক তখনই কোন এক পুণ্যকর্মের পুরস্কারস্বরুপ একটি খালি পিক আপ ভ্যান এসে হাজির! ফাও লিফট নিয়ে এগিয়ে এলাম প্রায় চার কিমি। নুরজাহান চা বাগানের প্রবেশ পথে নেমে পড়লাম সবাই। এবার নিজ পায়ে হাটা । চা বাগানের ভেতর দিয়ে হাটতে হাটতে এক পাহাড়ি বাড়ির সামনে মিলল টিউবওয়েল! আহা! ইতোপূর্বে সংগৃহীত লেবু দিয়ে শরবত বানানোর রসদ পাওয়া গেল। শরবত বানানোর সময় অগ্রগামী দল খবর দিল সামনে একটা স্কুল আছে। দে ছুট স্কুল মাঠের দিকে। জলের বন্দোবস্ত আছে সেখানেও। চমক এখানেই শেষ নয়। স্কুলের মাঠের আগেই পড়ল একটা ঝুপড়ি দোকান। দোকানে ঢুকলাম মুড়ি কিনতে আর কিনলাম সুগন্ধি পোলাও (!) , ছোলা, মুড়ি। ছোলা আর পোলাও একসাথে মিশিয়ে এখানে বলা হয় ‘চনাপোলাও’! স্কুল মাঠেই শুয়ে গড়িয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে মুফতে পাওয়া গেল একটি তাজা আনারস। একটু পরে অবশ্য কিনেছি গোটাকয়, একেবারে সদ্য ক্ষেত থেকে তোলা।  আবার চলা শুরু। রোদের তেজ কমছেনা । সবার অবস্থা তেমন সুবিধের নয়। একটু পরেই কোথা থেকে উড়ে এল একটি সিএনজি, আল্লা মালুম। আমরা হাঁটছিলাম একটু ঘুরতি পথে। গন্তব্য মাধবপুর লেক। এ পথে গাড়ি আসেনা সহজে। যেকয়টি আসে সেগুলো নয় চা বাগানের নয় কোন মালামাল সাপ্লাই দিতে বাঁ নিতে আসে। কিন্তু আমাদের তো রাজকপাল! ঠিক হল তিন ট্রিপে আমাদেরকে মাধবপুর লেক এ পৌঁছে দেবে। প্রথম ট্রিপে ব্যাগপত্তর সহ চলে গেল চারজন। আমরা হাঁটলাম আরো অনেকক্ষণ। এক ফাঁকে একটু আগে কেনা আনারস কয়টা পেটে চালান করে দিলাম।  হাটতে হাটতে বেলা ফুরোয়, ফুরিয়ে গেল চা বাগান।  সম্মুখে পাহাড়ি জঙ্গল আর এক টুকরো অপূর্ব সুপারি বাগান! গোধূলির আগে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অবশেষে সবকজন বন্ধু মাধবপুর লেক এ যখন পৌছুলাম তখন প্রায় সন্ধে সাতটা।  



সাধুর ডেরায় রাত্রিযাপন...  বেগ ভাইয়ের নেটওয়ার্ক পুরাই 4G, পাহাড়েও সচল। সে নেটওয়ার্ক থেকে বেরিয়ে এলেন সাধু ভাই, চা বাগানের শ্রমিক। নামে সাধু, কাজে কর্মেও বড়ই সাধাসিধা। মাধবপুর লেকের অদূরেই চা বাগানের ভেতর তাঁর বাসা। ফুটফুটে দুটি বাচ্চা জয় আর রুপা, সাধুর বঊ আর তার মা, এই আমাদের আশ্রয়দাতা পরিবার। মহা আদরে আমাদেরকে ঠাই দিলেন তাঁর ডেরায়। চারপাশে ঘরের মাঝখানে উঠান। উঠানে বিশাল চট বিছানো। এরই মধ্যে শিউলি এসে পৌঁছেছে বাস যোগে। রাতের রান্নার আয়োজন করতে হবে আমাদেরকেই। খিচুড়ির যোগাড়যন্তর শুরু হল। এরই মধ্যে মাধব পুর লেক এ গোসলের বন্দোবস্তও করা হল যদিও লেক এ সন্ধ্যার পর প্রবেশ নিষেধ এবং যেকোনো সময়ে গোসল করাও নিষেধ। এর কোনটাই মানতে পারিনি আমরা । সারাদিনের ক্লান্তি লেকের জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম । সাধুর বাড়িতে এত্ত মেহমান দেখে আশেপাশে গুঞ্জন ! আমরা ফিরলাম একটু ঘুরপথে । এদিকে খড়িকাঠের চুলায় খিচুড়ি আর ডিম ভুনার যুদ্ধে মুক্তা লড়ছে অনেকের সাহায্য নিয়েই। এতগুলো গিনিপিগ কোথায় পেত সে! বিনা ফিতে মুক্তাকে কাঠের চুলায় দুই পাতিল খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণ দেয়া হল (নিজ দায়িত্বে বিশ্বাস করবেন )! মধ্যরাতে ক্ষুধার্ত পেটে খিচুরি যেন অমৃত! রাত বাড়ছে, কেউ ঘুমায়না তবু। ছোট্ট জয় এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার কাছে। ঘরে ঘুমানোর জায়গা ছিল কিন্তু আমাদের বাউণ্ডুলে মনতো খোলা আকাশ চায়, তাই বারান্দা‍য় ,  উঠানেই বিছানা পাতা হল। উঠানে পাতা হল তিনটে তাঁবু। মাঝরাতে এলো বৃষ্টি। রত্নাদের তাবুতে পানি ঢুকেছে। চোখ মেলে একপলক দেখলাম হাফিজ ভাই প্লাস্টিক ঝুলিয়ে বৃষ্টি আটকাচ্ছে। আমি আরো নিশ্চিন্ত হয়ে গামছাটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম।  

যাইবাম হামহাম ----  ভোরের আলো ফুটতেই বিছানা ছাড়লাম। আজকের গন্তব্য হাম হাম জলপ্রপাত। জরুরী খাবারদাবার, পানীয় নিয়ে সবাই প্রস্তুত। আগের রাতেই স্থানীয় দোকানে পরোটা, ডাল, ডিম এর অর্ডার দেয়া ছিল। ভাড়া করা হয়েছিল একটি পিক আপ ভ্যানও। খাবারের দোকানে  গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেলাম। দোকানী পুরি বানাচ্ছে! পুরি আর পরোটার পার্থক্য বোঝাতে বেশি সময় নেয়া গেলনা। যাইহোক সময় বাচাতে আগের রাতের খিচুড়ি, গরম পুরি, ডাল খেয়েই গাড়িতে উঠলাম। রাতের বৃষ্টিতে পথ খারাপ হয়েছে কিছুটা। কলাবন এর কাছাকাছি এসে ভুল পথে নেমে পড়ল গাড়ি। একটু পর পাহাড়ি রাস্তার কাদায় আটকে গেল গাড়ি। দড়ি ছিলই আমাদের সাথে। দড়ি বেঁধে তোলা হল কাদা থেকে, একটু পর আবার আটকে পড়ল কাদায়। এবার আর আমাদের বাহুবলে কাজ হলনা। অগত্যা গাড়ি ছেড়ে হাটা শুরু। পরে চা বাগানের ট্রাক এসে টেনে তুলেছিল গাড়িটি।      

বাঁশ হাতে পাহাড়ি পথে ...  ধীরে ধীরে বনে ঢুকে পড়লাম। সাথে আছে সাধু ভাই, হাতে তার দা। আরো আছে স্থানীয় সজল ভাই, এই মুহূর্তে তাঁর পদবী ‘গাইড’ , যদিও বেগ ভাইই বিনা চুক্তিতে এই দায়িত্ব বহন করেছেন শেষ পর্যন্ত। বাঁশের লাঠি ঠুকে ঠুকে উঁচু নিচু পথ বেয়ে চললাম আমরা। একটু জিরিয়ে, আনারস, চকোলেট চিবিয়ে চলছি দারুণ উদ্যমে। ওহ বলাই হয়নি, পুরো দলের কাছে মাত্র একটি ক্যামেরাই ছিল আর ক্যামেরা চালনায় নিশাত আপু এবং নিঝু ছিলেন সার্বক্ষণিক দায়িত্বে। অহেতুক সেলফিগিরিতে খুব বেশি সময় নষ্ট হয়নি তাই।  পাহাড়ে উঠছি আর বেগ ভাইয়ের গল্প শুনছি। আমাদের বানোয়াট বিয়ার গ্রিলস এর গল্প থেমে গেছে বেগ ভাইয়ের গল্পে। প্রয়াত দুঃসাহসী অভিযাত্রী সজল খালেদ এর প্রসঙ্গ আসছিল ঘুরে ফিরেই। হয়তো অলক্ষ্যে ছিলেন আমাদের সাথেই। এই সফরে আমার মত নাগরিক পথিকের বড় পাওনা এটাই। দূরের এভারেস্ট কিংবা কাছের ক্রেওকাডাং হয়তো অধরা থেকে যায় আজীবন। তবুওতো নাগরিক জীবন থেকে একটু সময় চুরি করে উড়াওড়ি  করছি , ঘোরাঘুরি করছি অপ্রয়োজনের প্রয়োজনে।  এইতো জীবন, এইতো মাধুরী।

 বন গভীর হচ্ছে আর মশা এবং জোঁকের শাসন বাড়ছে। একটু পরপরই কারো না কারো গায়ে পায়ে জোঁক মিলছে। নিঝুকে রীতিমত ভেষজ চিকিৎসা দিতে হল  রক্তক্ষরণ থামাতে।   

 দুজন জাপানী পর্যটক পেরিয়ে গেলেন আমাদের। আরো কয়েকজন পর্যটক এর দেখা মিলল কিন্তু ঝিরিপথের দেখা মেলেনা। গাইড সজল ভাইয়ের কথা মত বাকি অর্ধেক পথ ফুরোতেই চায়না! অবশেষে দেখা মিলল ঝিরিপথের। পানিতে পা চুবিয়েই শান্তি। আহা! আর একটু পা চালিয়ে পৌঁছে গেলাম হাম হাম জলপ্রপাত এ।

 হাম হাম শব্দের মানে জলের ধ্বনি। জলপতনের ধ্বনি শোনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত।  বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। সামনে পাহাড়ের বুক চিরে বিপুল জলরাশি আছড়ে পড়ছে নিচে। সাতার জানা না জানা সবাই জলে দাপাদাপি করতে নেমে পড়ল। কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে চা পান পর্বটি ছিল অন্যরকম আনন্দের।

ফিরব ঝিরি পথে ...সিঁড়ি পথে...  এবার ফেরার পালা। স্থানীয় মানুষজন ঝিরিপথে যেতে বারণ করল বারবার, সেটাই আমাদের উৎসাহিত করল আরো বেশি বার ! আমাদের গাইড এ পথ চেনেনা। বেগ ভাই এর মগজের উপর অগাধ আস্থা আমাদের বরাবরের মতই। তারপরেও পাহাড়ি পথ না ঝিরি পথ এ নিয়ে কথা চলছিল কিন্তু পাহাড়ে পথে ফেরার রাস্তাটা পেছনে ফেলে আসতেই আর কোন সংশয় রইলোনা। আমাদের গাইড একটু শঙ্কা জানাল, সামনে রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে। জবার দিল সাধু ভাই। বলে ‘দা আছেনা, কেটে কুটে চলে যাব’ ! বুঝলাম আমাদের তালে পড়ে গেছে বেচারা। নতুন পথে বেশ লাগছিল। পথেই পড়ল একটা ছোট ঝরনা। আরো একটু গভীরে ঢুকেই একটু বিপাকে পড়লাম আমরা। উত্তেজনায় খেয়াল করিনি পাশের পাহাড়ের উপর দিয়ে বিকল্প পথ আছে ফিরে যাবার।

সেই পথের সিঁড়ি আমরা পেরিয়ে এসেছি। সামনে পথ কিছুটা দুর্গম হয়ে উঠল। একজায়গায় এসে রীতিমত খেই হারিয়ে ফেললাম। সামনে গভীর খাদ, সাতরে পেরুতে হবে অথবা পাথুরে দেয়াল বেয়ে যেতে হবে। সমাধান হাতের কাছেই। লম্বা একটা বাঁশ পড়ে আছে সামনে। বাবু ও ইউসুফ খুব সহজেই পেরিয়ে গেল। একটু এগিয়ে সে জানাল সমস্যা নেই, সামনে ভাল পথ। এরপর অনেক কায়দা কসরত করে , দেয়ালে বাঁশ  গেঁথে সবাই এই খাড়া দেয়াল বেয়ে ওপাশে গেলাম।  একটু সামনে এগিয়ে দেখি পথ বন্ধ। পেরুবার উপায় নেই। কোন পথে যাব এখন! গুগল ম্যাপ দেখারো সুযোগ নেই। প্রায়  তিনটা বাজে তখন। সন্ধ্যার আগেই ফেরার অনিশ্চয়তা জেগে উঠল।  বেগ ভাই, ইউসুফ দড়ি বেয়ে উঠে গেল পাহাড়ের উপরে। ঘন বাঁশঝাড় ফুঁড়ে বেশি এগুতে পারলনা। অগত্যা পিছিয়ে যাওয়া। আবার সেই খাড়া দেয়াল পাড়ি দেয়া! এবার আর অতটা সমস্যা হয়নি। একটু এগুতেই অবশ্য সেই বিকল্প পথের দেখা পাওয়া গেল। পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সে পথের চিহ্ন ধরে পড়লাম আরেক ঝিরিপথে। এই ঝিরিটি  আগেরটির মত অগভীরও নয়, পাথুরে মাটির নয়। একটু পরপর গভীর কাদার স্তর পেরুতে হচ্ছিল। ডানে বামে ঘুরে,  কাদা জল ডিঙ্গিয়ে এক সময় টিলাপথে উঠে পড়লাম। এ পথ আর ফুরোয়না। বাঁশ বন, কলাবন, ছোট বড় খাল, ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে যখন বন থেকে বেরিয়ে এলাম তখন সন্ধ্যা সমাগত।        




আমি ফিরা আইলাম গো মামু ... না কাউরে ঝিরিপথে ভাসিয়ে দিয়ে আসিনি। সবাই বহাল তবিয়তে ফিরে এসেছি। নিজেদের পায়ের দিকে আর তাকানো যাচ্ছেনা। ক্ষুধা ও ক্লান্তি  দুটোই তখন চরমে। প্রায় পৌনে সাতটা বাজে তখন। গাড়ি এসে গেছে আমাদের নিতে। ঝুপড়ি হোটেলে খাবারের অর্ডার দেয়া ছিল আগেই। কাছেই এক বাড়িতে কুয়ো থেকে পানি তুলে কোনরকমে গা ধুয়ে খাবার টেবলে বসে পড়লাম। ডাল ডিম আলুভর্তাই তখন বিরিয়ানীসম। এরপর এক কাপ চা তো অমৃত সুধা ! এবার ফেরার পালা। সাধুর বাড়ি থেকে দ্রুত ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিলাম সবাই। গাড়ি ভাড়া নিয়ে কিঞ্চিৎ বচসা হল মালিকের সাথে। শেষ পর্যন্ত রফা হল একটা। এদিকে সাধু ভাইয়ের পরিবারের সবাই আবেগ ঘন বিদায় দিল। বাচ্চা দুটোর সাথে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে দেখা হবে।  

শেষের আগে ...  রাতের খাবারের জন্য রেল স্টেশনের অদূরের বাজারে রূপসী বাংলা হোটেলে ঢুকলাম। এত বড় বাজারে খুব বেশি হোটেল চোখে পড়লনা। গরম গরম মাছ ভাত (কেউ কেউ মুরগী ভাত) খেয়ে কিঞ্চিত মিষ্টিমুখ করা হল আম এবং লটকন সহযোগে। এরই মধ্যে নিশাত আপু এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল ঐ হোটেলের পেছনেই একটা বিশাল পুকুর পাড়ে। পুকুরের এপারে ঘাট বাধানো অন্য পাড়ে  বেশ পুরনো ঘরবাড়ী। ওখানেই বাকি আম লটকন শেষ করে দিলাম।        

উপবন এ কতজন?  আমাদের ঢাকায় ফেরার বাহন উপবন এক্সপ্রেস এসে পৌঁছল রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ। আমাদের সবার সিট এক বগিতে নয়। পাঁচজন চলে গেলাম সামনের বগিতে, বাকিরা অন্য বগিতে। কিন্তু দুঃখে এখানেই শেষ নয়। মধুরেণ সমাপয়েত হইলনা। ট্রেন ছাড়তেই শুনলাম একটি বগি নেই ট্রেনটিতে আর আমাদের বাকি সিটগুলো ঐ বগিতেই ছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারণে ঐ বগি যুক্ত করা হয়নি। ফেরার রাতটা তাই সংগ্রাম করেই কাটাতে হল।    

এইখানে নটে গাছটি মুড়নো হল। দেখা হবে আগামী সফরে । ভুপেন হাজারিকার গানটির মত কানে এখনো হাম হাম এর জলধ্বনি ...।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত